মালিক বিন আনাস (র:) ছিলেন মস্ত এক ইমাম। তিনি সেসব অনুসৃত পন্ডিতদের মাঝে ছিলেন যাদের জ্ঞান দিগন্ত স্পর্শ করেছে। যার মাযহাবকে আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন স্থায়ীত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা। তিনি সেসব বরেণ্য সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত যাদের স্মরণে নেমে আসে রহমত, যাদের জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে আদর্শ। আমরা কথা বলব হিজরতকারীদের যে দেশ মদীনা সে দেশের ইমামের ব্যাপারে: ইমাম মালিক বিন আনাস (র:)।

 

তার জন্ম ও সুসংবাদ

 

ক্ষণজন্মা মহান ইমাম মালিক বিন আনাস বিন মালিক বিন আবী ‘আমির আল-আসবাহী আল-মাদানী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ৯৩ হিজরি সনে। এটা সেই বছর যাতে সাহাবী আনাস বিন মালিক (রা:) মৃত্যুবরণ করেন। ফলে আল্লাহ্‌ তা’আলা উম্মাহ্‌কে এই ইমাম দিয়ে শূণ্যতা পূরণ করলেন।  

 

ইমাম মালিকের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে সহীহ হাদীস এসেছে যা চার সুনানের ইমামগণ ও আহমাদ বর্ণনা করেছেন: নবীজী (সা:) বলেন: “এরকম অবস্থা দাঁড়াবে যে মানুষ দ্রুত উটে সওয়ার হয়ে ভ্রমণ করবে ‘ইলমের সন্ধানে, তারা মদীনার ‘আলেমের চেয়ে অধিক জ্ঞানী কাউকে পাবে না।”[১] আত-তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বা ভালো আখ্যা দিয়েছেন এবং আল-হাকিম একে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন। আয-যাহাবী বলেন: “এ হাদীসের বর্ণনাসূত্রটি পরিষ্কার এবং মাত্‌নটি গরীব”[২] ইব্‌ন হিব্বান ও অন্যান্যরা একে সাহীহ বলেছেন।

 

একদল ‘উলামা, যাদের মাঝে রয়েছেন ইব্‌ন ‘উয়াইনাহ্‌ ও ইব্‌ন জুরায়জ, মনে করেন হাদীসটির উদ্দেশ্য ইমাম মালিক, তিনিই আল্লাহ্‌র নবীর (সা:) সুসংবাদপ্রাপ্ত ‘আলেম যিনি আর কিছুদিনের মাঝেই ‘উলামাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ ‘আলেম হতে চলেছেন, ফলে তিনি হলেন মদীনার সেই ‘আলেম যার দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছে। তার দিকে অচিরেই মানুষ দ্রুত উট চড়িয়ে ভ্রমণ করে আসবে সর্বত্র থেকে।

 

মালিক বিন আনাস ছিলেন ধীর্ঘদেহী। বৃহৎ করোটি, চুল ছিলো না। মাথা এবং দাড়ি ছিলো শ্বেতবর্ণী। গায়ের ত্বক ছিলো ধবধবে সাদা থেকে একটু লালচে। তার পোশাক ছিলো ইয়েমেনের ‘আদ্‌ন শহরের অত্যন্ত ভালো মানের জোব্বা। তিনি গোঁফ পুরোপুরি ছাঁটা অপছন্দ করতেন এবং এটাকে ভুল মনে করতেন।

 

তার জ্ঞান ও ‘উলামাদের সাক্ষ্য

 

ইমাম মালিক (র:) প্রচুর শায়খদের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাদের অনেকেই ছিলেন ডাকসাঁইটে তাবি’ঈ। আশ-শাফি’ঈ (র:) তার ব্যাপারে বলেন: “কোনও বর্ণনা আসলে মালিক ছিলেন তারকার তূল্য” [৩] (অনু: যেভাবে তারা পথ দেখায় যে কোনও বর্ণনার ক্ষেত্রে মালিকও তেমনি পথপ্রদর্শক)

 

ইব্‌ন মা’ঈন (র:) তার ব্যাপারে বলেন: “মালিক ছিলেন সৃষ্টির কাছে প্রেরিত আল্লাহ্‌র প্রমাণগুলোর একটি।”[৪]

 

তিনি ছিলেন একজন মুহাদ্দিস। অসংখ্য মানুষ তার কাছ থেকে হাদীস নিয়েছেন। তার মহাগ্রন্থ “আল-মুওয়াত্তা”। এটি হচ্ছে যেমনটি আশ-শাফি’ঈ (র:) বলেছেন: “আল্লাহ্‌র কিতাবের পর পৃথিবীপৃষ্ঠে আর একটিও বই নেই যা মালিকের বইয়ের চেয়ে সঠিকতর।”[৫]

 

আশ-শাফি’ঈ (র:) কথাটি বলেছেন এ কারণে যে তখনও মানুষের হাতে সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিম এসে পৌঁছয়নি। ফলে আল-মুওয়াত্তা ছিলো তার সময়ে আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা:) হাদীসের বই সমূহের মধ্যে সঠিকতর।

 

আশ-শাফি’ঈ বলেন: “যদি কোনও বর্ণনা হাতে আসে তবে মালিক হচ্ছেন তারার মতো।”[৬]

 

তিনি আরও বলেন: “মালিক এবং ইব্‌ন ‘উয়াইনাহ্‌ হচ্ছেন দোসর। যদি তারা না থাকতেন হিজাযের জ্ঞান বিতাড়িত হতো।”[৭]

 

আশ-শাফি’ঈ এও বলেন: “যদি মালিকের কাছ থেকে কোনও হাদীস আসে তাহলে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো।”[৮]

 

সুফ্‌য়ান বলেন: “মালিক হচ্ছেন ইমাম।”[৯]

 

ইয়াহ্‌ইয়া বিন সা’ঈদ আল-কাত্তান বলেন: “মালিক হচ্ছেন হাদীসের আমীরুল-মু’মিনীন।”[১০]

 

ইব্‌ন ওয়াহ্‌ব বলেন: “মালিক যদি না হতেন আমরা রসাতলে যেতাম।”[১১]

 

ইব্‌ন কিলাবাহ বলেন: “মালিক ছিলেন তার সময়কার সবচেয়ে বড় (হাদীস) সংরক্ষণকারী।”[১২]

 

ইব্‌ন উয়াইস হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে আমার মামা মালিক বিন আনাস বলেছেন: “এই জ্ঞান হচ্ছে দ্বীন, সুতরাং খেয়াল করো কার কাছ থেকে তোমাদের দ্বীন নিচ্ছ। আমি এই থামগুলোর কাছে সত্তর জনকে দেখেছি যারা বলেছে যে অমুক বলেছে যে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা:) বলেছেন, কিন্তু আমি তাদের কাছ থেকে কিচ্ছু নিইনি। অথচ এদের একজনের কাছেও যদি বায়তুল মালকে আমানত হিসেবে রাখা হয় তারা বিশ্বস্তই থাকবে। (নিইনি) কেননা তারা এই বিষয়ের মানুষ না। এরপর আমাদের কাছে এলেন ইব্‌ন শিহাব আয্‌-যুহরী, তো আমরা তার দরজায় ভিড় জমালাম।”[১৩]

 

তিনি ছিলেন একজন ফিক্‌হ (ইসলামি বিধান শাস্ত্র) শাস্ত্রবিদ বা ফাকীহ। তার মাযহাব দিগন্তভর বিস্তৃত হয়েছে। প্রচার পেয়েছে মরক্কো, আনদালুস (মুসলিম স্পেনের একটি প্রদেশ), মিসরের বহু রাজ্য, শামের কিছু দেশ, ইয়েমেন, সুদান, বাগদাদ, কূফা ও খুরাসানের কিছু অংশ, আলজেরিয়ার কিছু দিক যেমন আহসা প্রভৃতি। আজ পর্যন্ত তার মাযহাব ৪টি প্রধাণ মাযহাবের একটি হিসেবে প্রচলিত ও বিখ্যাত হয়ে আছে।

 

তার জ্ঞান অর্জনের কাহিনী

 

ইমাম মালিক (র:) যখন জ্ঞান অর্জন করতেন তখন তার বয়স দশের সামান্য বেশি। যখন তিনি ফাতওয়া ইস্যু করার যোগ্যতা অর্জন করলেন তার বয়স মোটে আঠার। আর ‘ইলমের মজলিসে শিক্ষক হিসেবে যখন তিনি বসা আরম্ভ করলেন, তার বয়স সবে একুশ। যখন মানুষ তার হাদীস বর্ণনা করতে শুরু করেছে তখন তিনি যুবাবয়সে পদার্পণ করেছেন মাত্র। আবূ জা’ফর আল-মানসূরের খিলাফাতের শেষদিকে মানুষ সর্বত্র থেকে মালিকের কাছে ভ্রমণ করে আসা শুরু করেছে এবং তার মৃত্যু অবধি তার কাছে তারা ভিড় জমিয়ে রাখত।

 

এই তথ্যগুলো থেকে আমরা সেই পরিবেশের ব্যাপারে আঁচ করতে পারি যাতে ইমাম মালিকের মতো যুবকরা আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলদের যুগে বেড়ে উঠেছেন, এ থেকে কয়েকটি জিনিস আমরা বুঝতে পারি:

 

প্রথমত: নবীর শহরে জ্ঞান অর্জনের মর্যাদা। ছোট ছেলেটি সেখানে বড় হতো এই দেখতে দেখতে যে সবাই শায়খের দিকে আঙুল নির্দেশ করছে। সেই ‘আলেম যখন সামনে আসতো তারা মাথা নিচু করতো, রাস্তা ছেড়ে দিতো, সালাম আদায় করতো এবং তাকে সম্মান দেখাতো। কেননা এই ‘আলেম আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা:) পথ নির্দেশনা ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জ্ঞান তার সাথে নিয়ে ঘুরতো। তারা মনে করতো তাকে সম্মাননা দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র দ্বীনকে সম্মান করা হচ্ছে। ফলে শিশুটি বড় হতো এই ‘আলেমের জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান বুকে নিয়ে। তার মাঝেই সে খুঁজে পেত রোল মডেল। সেও চাইতো শায়খের উচ্চতায় ও মর্যাদায় পৌঁছতে।

 

ফলে শিশুটি কার্যত ছোটবেলা থেকেই ‘উলামা, ফুকাহা, দ্বীনের পথে আহ্বানকারী ও জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পেত।

 

ইমাম আশ-শাফি’ঈ (র:), যিনি ইমাম মালিকের ছাত্র ছিলেন, বলেন: “আমি মালিক বিন আনাসের মাঝে যা দেখেছি তা হোলো সম্ভ্রম ও জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা। আমার মধ্যে এই অনুভূতি বড় হওয়া শুরু করলো এমনভাবে যে কখনও যদি আমি তার মজলিসে বসে পৃষ্ঠা উল্টাতে চাইতাম, তখন খুব সন্তর্পণে পৃষ্ঠা উল্টোতাম, তার প্রতি সম্ভ্রমের কারণে। তিনি যেন শব্দ না পান।”[১৪]

 

দ্বিতীয়ত: আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলদের প্রজন্মে পরিবেশ এবং মাধ্যমগুলো এমন ছিলো যে সেগুলো শিক্ষার প্রদানের জন্য তৈরি ছিলো। একজন ব্যক্তির শিক্ষা লাভের মাঝে কোনও বাধা বা ঝামেলা ছিলো না। ‘আলেম হোক অথবা ছাত্র – চাই কী তার বয়স চৌদ্দই হোক বা তার চেয়েও কম – যখন সে মসজিদে আসতো, সকল দরজাই খোলা পেত। সকল সুযোগই থাকতো উন্মুক্ত। মজলিসগুলো শিক্ষা দেয়ার জন্য তৈরি। যখন সে মার্কেটে যেত দেখত পড়াশোনার জন্য যা যা লাগবে তার সেগুলো সবই মিলছে। যখন সে বাড়িতে আসতো, সে বাবা-মা, ভাই-বোন ও পরিবারের সকল সদস্যের কাছে পেত ‘ইলম অর্জনের ও অব্যাহত রাখার আরও উৎসাহ যা কীনা তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতো। যেন গোটা সমাজটিই তাকে মুখে বা হাবেভাবে বলতে চাইছে: “‘ইলম অর্জন করো, আমরা তোমার পেছনে আছি। যা সাহায্য লাগে আমরা দেব।”

 

ইমাম মালিকের সাথে তার মায়ের একটি গল্প আছে যা খুবই বিখ্যাত। তিনি ছেলেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচন্ড উৎসাহ দিতেন। তার কাছে টাকা পয়সা যা আছে তা দিয়ে তিনি তাকে সাহায্য করতেন এই কাজে। যাতে করে তাকে ব্যবসায়ের হাল না ধরতে হয়। কেননা মাথায় যদি জীবিকা উপার্জনের চিন্তা ভর করে থাকে তবে তা অবশ্যই জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে দূর্বল করে দেবে।[১৫] যেমনটি ইমাম আশ-শাফি’ঈ (র:) বলেছেন: “পেঁয়াজ কেনার কথা মাথায় ঘুরপাক খেলে মাসআলাহ (ফিক্‌হি সমস্যা) বোঝা লাটে উঠবে।”[১৬]

 

আশ-শাফি’ঈর এই কথা প্রতিকী বটে। তা নাহলে নবীর (সা:) সাহাবীগণ খাওয়া দাওয়া করতেন, বাজারে যেতেন, কেনাবেচা করতেন, চাষবাস করতেন, জিহাদ করতেন আবার পড়াশোনাও করতেন। এসব কিছুর পরও তারা ছিলেন ‘উলামাদেরও ‘উলামা।

 

কথা হোলো এই যে সমাজের উচিৎ একজন ‘ইলমের ছাত্রের জন্য সাহায্য ও সমর্থন দেয়া। যাতে করে একেবারে কচি বয়স থেকেই সে জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং এর মাধ্যমগুলো তার জন্য তৈরি থাকে।

 

 

ফুটনোট

 

[১] হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমাদ (৭৯২০), আন-নাসাঈ (৪২৯১) ও আত-তিরমিযী (২৬৮০)। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান (এখানে বর্ণিত ভাষ্যটি তার)। হাদীসটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন ইব্‌ন হিব্বান (৩৭৩৬), আল-হাকিম তার মুসতাদরাকে (১/১৬৮) এবং তিনি বলেন: “মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ, বুখারী ও মুসলিম কেউই যদিও হাদীসটি বর্ণনা করেননি। আল-বায়হাকীও এটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন (১৬৮১)।

[২] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৮/৫০)

[৩] আল-জার্‌হ ওয়াত-তা’দীল (১/২৬০), হিলয়াতুল-আউলিয়া (৬/৩১৮), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৮/৯৬), আল-ইনতিকা: ইব্‌ন ‘আবদুল বার্‌র (পৃঃ ৫৫)

[৪] আল-ইনতিকা: ইব্‌ন ‘আবদুল বার্‌র (পৃঃ ৬৫), আত-তামহীদ (১/৭৭), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৮/৯৪)।

[৫] আত-তামহীদ (১/৭৭), ইব্‌ন আবী হাতিম তার আল-জার্‌হ ওয়াত-তা’দীলে (১/১২)

[6] ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেছেন আল-জার্‌হ ওয়াত-তা’দীলে (১/১৪), ইব্‌ন ‘আদী করেছেন আল-কামিলে (১/৯২), ইব্‌ন ‘আবদুল-বার্‌র আত-তামহীদে (১/৬৪)

[৭] ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেছেন আল-জার্‌হ ওয়াত-তা’দীলে (১/১২)

[৮] ঐ (১/১৪), ইব্‌ন ‘আদী: আল-কামিল (১/৯১)

[৯] আত-তারীখুল-কাবীর: আল-বুখারী (৭/৩১০)

[১০] তায্‌য়ীনুল-মামালিক: আস-সুয়ূতী (পৃঃ ১৯)

[১১] আত-তামহীদ: ইব্‌ন ‘আবদুল-বার্‌র (১/৬২)

[১২] তায্‌য়ীনুল-মামালিক: আস-সুয়ূতী (পৃঃ ২০)

[১৩] আত-তামহীদ: ইব্‌ন ‘আবদুল-বার্‌র (১/৬৬), আল-হিল্‌য়াহ: আবূ নু’আয়ম (৬/৩২৩)

[১৪] মানাকিবুশ-শাফি’ঈ: আল-বায়হাকী (২/১৪৪)

[১৫] আল-জামি’: আল-খাতীব আল-বাগদাদী (২/৩৮৪), আদ-দীবাজুল-মাযহাব (পৃঃ ২০)

[১৬] তাযকিরাতুস-সামি’ ওয়াল-মুতাকাল্লিম: ইবন জামা’আহ (পৃঃ ৭০-৭১)

জ্ঞানের প্রতি তার একাগ্রতা এবং দুনিয়া-বিমুখতা

 

তখনকার দিনে আজকের মতো শিক্ষা দীক্ষা এত বাধ্যতামূলক ছিলো না। সে যুগে তরুণরাও সবাই কিন্তু শার’ঈ জ্ঞানের মজলিসে বসতো না। তবে সেই পরিমাণ ছাত্র সবসময়ই মিলতো যাদের মাধ্যমে কাজ চলে যেত এবং আল্লাহ্‌র এই ঐশী নির্দেশ প্রতিপন্ন হতো: “মু’মিনদের জন্য এটি সমীচীণ নয় যে তারা একজোট হয়ে বেরিয়ে পড়বে, তাহলে কেন না তাদের প্রতিটি গোত্র থেকে একদল বের হয়ে আসে দ্বীনকে ভালো করে রপ্ত করার জন্য এবং ফিরে গিয়ে তাদের লোকদের সতর্ক করার জন্য যাতে তারা সাবধান হয়।”[আত-তাওবাহ্‌: ১২২]

 

ইমাম মালিক খুব অল্প বয়সেই জ্ঞান অর্জনের কাজ শুরু করেন। তিনি সাত বছর ইব্‌ন হুরমুযের কাছে ব্যয় করেন এবং এসময়টায় তিনি আর কারও সাথে মেশেননি।

 

ইমাম মালিকের জ্ঞানের প্রতি যে যত্ন তার প্রমাণস্বরূপ বর্ণনা এসেছে যে তিনি লম্বা সময় শায়খের দরজার সামনে অবস্থান নিতেন। ইব্‌ন হুরমুয টের পেতেন যে দরজায় কেউ আছে। তিনি কাজের মেয়েটিকে বলতেন দেখে আসতে। সে দেখে এসে তাকে জানাতো যে: “আর কে ঐ ফর্সা ছেলেটা ছাড়া!” তিনি বলতেন: “ডাকো ওকে, ও হচ্ছে মানুষদের ‘আলেম।”[১]

 

আরেকটি গল্প থেকেও মালিকের জ্ঞানের প্রতি আচরণ বোঝা যায়। সেটি হোলো ‘আবদুল্লাহ্‌ ইবন ‘উমারের খাদেম নাফি’-র কাছে তার যাওয়ার গল্প। তিনি একটি ফন্দি করতেন যাতে নাফি’-র সাথে দেখা হবার আগে তিনি বেশ কষ্ট করেছেন এরকমটা বোঝানো যায়। এজন্য তিনি দীর্ঘ সময় সূর্যের প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এরপর নাফি’ দেখা দিলে মালিক তাকে অনুসরণ করতেন। এরপর তার সুযোগ মিলত তাকে জিজ্ঞেস করার এবং তার কাছে জ্ঞান নেবার। মালিক নিজেই গল্পটি এভাবে বর্ণনা করেছেন: “আমি বেলা দ্বিপ্রহরে নাফি’র কাছে যেতাম, সেসময় গাছও সূর্য থেকে আমাকে ছায়া দিতে পারতো না। আমি তার বের হয়ে আসার জন্য বসে থাকতাম। এরপর তিনি বের হলে আমি এক ঘন্টার জন্য তাকে ছেড়ে দিতাম যেন আমি তাকে দেখিইনি। এরপর আমি তার কাছে যেতাম এবং সালাম দিতাম, এরপর আবার ছেড়ে দিতাম। এরপর যখন তিনি মসজিদে ঢুকলেন আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম: “ইব্‌ন ‘উমার এই এই ব্যাপারে কী বলেছেন?” তখন তিনি উত্তর দিতেন। অতঃপর আমি তাকে ছেড়ে দিতাম।”[২]

 

মালিক ছুটির দিন বলে কিছু বুঝতেন না, এমনকী ঈদের দিন হলেও। বরং তিনি ঈদের দিনের জন্যই অপেক্ষা করতেন কারণ জানতেন যে সেদিন ভিড়-ভাট্টা কম হবে। ফলে সেদিন তিনি ইবন শিহাব আয-যুহরীর বাড়িতে যেতেন, আয-যুহরী শাম থেকে মদীনায় ফিরে আসার পর।

 

এই ঈদের দিন পাঠ নেয়ার গল্পও মালিক নিজেই বলেছেন: “ঈদের দিন যখন আসলো আমি নিজেকে বললাম এই দিনে তো ইব্‌ন শিহাব খালি থাকবেন। তাই আমি মুসাল্লা (সালাত আদায়ের জায়গা) থেকে বের হয়ে তার দরজার সামনে গিয়ে বসলাম। আমি শুনতে পেলাম যে তিনি তার কাজের মেয়েটিকে বলছেন দেখতে দরজায় কে? সে দেখে তাকে বলল: ‘আপনার সেই ফর্সা মওলা মালিক।’ তিনি বললেন: ‘ঢোকাও ওকে।’ আমি ঢুকলাম। তিনি বললেন: ‘কী ব্যাপার তুমি বাড়ি যাওনি?’ বললাম: ‘না।’ তিনি বললেন: ‘খেয়েছ কিছু?’ বললাম: ‘না।’ বললেন: ‘খাও তাহলে এখন।’ আমি বললাম: ‘দরকার নেই।’ তিনি বললেন: ‘কী চাচ্ছ তাহলে?’ বললাম: ‘হাদীস বলুন আমাকে।’ তখন তিনি বললেন: ‘ঠিক আছে, নাও।’ আমি তখন আমার শ্লেট বের করলাম এবং তিনি আমাকে চল্লিশটি হাদীস বললেন। আমি তখন বললাম: ‘আরও বলুন।’ তিনি বললেন: ‘যথেষ্ট হয়েছে, তুমি যদি এই হাদীসগুলো বর্ণনা করতে পারো তাহলে তুমি একজন হাফিয।” আমি বললাম: “করেছি আমি বর্ণনা এগুলো।’ তখন তিনি আমার হাত থেকে শ্লেটগুলো নিয়ে নিলেন এবং বললেন: “বলো।” আমি ঠিকঠাক বললাম। তিনি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন: “ওঠো, তুমি এখন জ্ঞানের এক আধার।”[৩]

 

ফুকাহা ও মুহাদ্দিসদের সাথে এই অধ্যবসায় মালিক কেবলমাত্র নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথেই পালন করতেন না, বরং পালন করতেন সানন্দে ও পূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে। তার অসামান্য প্রতিভা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেছে। আরও যে ব্যাপারটি তাকে সাহায্য করেছে সেটি হোলো বহু সংখ্যক ফাকীহদের উপস্থিতি এবং তাদের সেই পর্যায়ের দয়া যে তারা ছাত্রদের ‘ঈদের দিনেও স্বাগত জানাতেন এবং তাদের জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করতেন। হবে নাই বা কেন, তারা ছিলেন মদীনার উস্তাদ যারা বেড়ে উঠেছেন আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা:) নিজ হাতে গড়া পরিবেশে। যেখানে তিনি (সা:) রেখে গেছেন উত্তম চারিত্রিক গুণাবলির সম্ভার যা কখনও ফুরোবার নয়।[৪]

 

ইমাম মালিক (র:) আজ আমাদের সামনে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্বের নমুনা যিনি নিজের প্রতিভা ও ক্ষমতাকে দেখেছেন জ্ঞানের সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে ইসলামকে খেদমত করার মাধ্যম হিসেবে।

 

দুনিয়ায় মজে যাওয়া মানুষদের সাথে মালিকের (র:) দেখা হয়েছিলো যারা তাকে জ্ঞানার্জন ছেড়ে দিতে প্ররোচিত করেছিলো। তিনি ঘৃণাভরে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে যা আল্লাহ্‌র কাছে রয়েছে সেটাই উত্তম এবং স্থায়ী।

 

আরেকদল এসে তাকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করল জ্ঞানের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বরং জিহাদের কাজে আত্মনিয়োগ করতে। তার মত ছিলো যে তিনি যা করছেন এটাও উত্তম আর তারা যা করছে সেটাও উত্তম। একটি ফারদ্‌ কিফায়াহ (সামষ্টিক ফরজ কাজ) অপরটির শূণ্যতা পূরণ করতে পারে না। প্রত্যেকেই ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে রয়েছে।

 

তার সাথে দেখা হোলো ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আবদুল ‘আযীয আল-‘উমরী-র মতো দুনিয়াবিমুখ মানুষের। আল-‘উমরী ছিলেন দুনিয়া-বিমুখতা, তাকওয়া, ধার্মিকতা ও সাধুতায় একজন ইমাম। যখন ইমাম মালিকের সাথে তার দেখা হোলো তিনি তাকে দুনিয়া-বিমুখতা এবং মানুষের সাথে মেলামেশা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানালেন। ইমাম মালিক মন দিয়ে তার কথা শুনলেন এবং তার জন্য দু’আ করলেন। কিন্তু তিনি তার মত গ্রহণ করলেন না যে মানুষের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে। বরং তিনি মানুষের মাঝে কাজ করা ও তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করাকেই শ্রেয় মনে করলেন।

 

কিন্তু আজকের দিনে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আবদুল-‘আযীযের মতো সাধু ব্যক্তিরাই বা কোথায়?

 

মালিক (র:) ‘আবদুল্লাহ্‌র কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ‘আয্‌যা ওয়া-জাল্ল্‌ কর্মসমূহকে ভাগ করেছেন যেভাবে তিনি রিজিককে ভাগ করেছেন। হয়তো একজন ব্যক্তির জন্য সালাতের দরজা যেভাবে খুলে দেয়া হয়েছে সেভাবে সাওমের দরজা খোলা হয়নি। আরেকজনের জন্য দান খয়রাতের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু সাওমের দরজা খোলা হয়নি। অপর একজনের জন্য জিহাদের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু সালাতের দরজা সেভাবে খোলেনি। জ্ঞানের প্রসার ঘটানো এবং শিক্ষা দেয়া উত্তম কর্মসমূহের সবচেয়ে ভালোগুলোর একটি। এ থেকে যতটুকু আমার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমি খুশি এবং আমি মনে করি না যা নিয়ে আমি আছি তা আপনি যা নিয়ে আছেন তার চেয়ে কম কিছু। আমি আশা করি যে আমরা প্রত্যেকেই ভালোর ওপর আছি। আমাদের প্রত্যেকের তাই উচিৎ হবে তার জন্য কর্মের যে ভাগ পড়েছে তাতে খুশি থাকা। সালাম আপনাকে।”[৫]

 

তার বেশভুসো

 

মালিক (র:) ছিলেন দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন। অত্যন্ত ফর্সা ছিলেন তিনি। সুন্দর চেহারা। টানা চোখ। যখন তিনি বাইরে আসতে চাইতেন মানুষের সামনে, ভালো করে সেজে গুজে সুগন্ধি ব্যবহার করে বের হতেন। তিনি মিস্‌ক ও অন্যান্য খুবই ভালো মানের সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। পোশাক-আসাকের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী। পূর্ণাঙ্গ সাজ ছাড়া তাকে কেউ কখনও দেখেনি।

 

বিশ্‌র বিন আল-হারিস বলেন: “আমি মালিকের কাছে আসলাম। দেখলাম যে তিনি একটি ‘তায়লাসান’ (দামী সবুজ কাপড় যাতে সেলাই থাকে না) গায়ে চাপিয়েছেন যার দাম অন্তত পাঁচশ (দিনার সম্ভবত) হবে, এর দুই পাশ তার চোখের ওপর এসে পড়েছিলো এবং দেখাচ্ছিলো একদম রাজা-বাদশাদের মতো।”[৬]

 

যখন তিনি পাগড়ি চাপাতেন সেটির দুই পাড়কে তিনি চিবুকের নিচ দিয়ে ঘাড়ের দুই পাশে ঝুলিয়ে দিতেন।[৭]

 

উলের কাপড় পড়ার ব্যাপারে তিনি বলতেন: “সফর ছাড়া ওটা পড়ার মধ্যে ভালো কিছু দেখি না, কেননা ওটা হচ্ছে প্রচারমুখিতা।” [৮] অর্থাৎ যে ওটা পড়ে সে মানুষকে তার দুনিয়াবিমুখতা ও বিনম্রতা প্রদর্শন করছে।

 

তিনি যখন হাদীসের পাঠ দিতে বের হতেন প্রথমে সালাতের জন্য অজু করতেন। এরপর তার সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরিধান করতেন। টুপি মাথায় দিতেন। দাড়ি আঁচড়াতেন। কেউ তাকে এটা নিয়ে খোঁটা দিলে তিনি বলতেন: “আমি এর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা:) হাদীসকে সম্মান দিচ্ছি।”[৯]

 

এই সুন্দর বেশবাস ধার্মিকতা, জ্ঞান, ইমামতি, বুদ্ধি বা ব্যক্তিত্ববোধের অন্তরায় নয়। বরং আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা:) শহরের মানুষ হিসেবে মালিকের জন্য এটা যথেষ্টই শোভা পায়। দুনিয়ার ঐশ্বর্য মানুষের হাতে আসা শুরু করেছিলো। এমন কাউকে তাদের দরকার ছিলো যে তাদের বুঝিয়ে দেবে এভাবে সাজসজ্জা করাতে কোনও সমস্যা নেই। তাছাড়া তার ব্যক্তিত্ব ও স্বভাবের সাথেও এটি ছিলো সাযুজ্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন বাদশাদের পৌত্র। নিজেও ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশীল ও রাশভারী। রাজারা তার দরজায় কড়া নাড়ত এবং তার সামনে এসে বসতো যেমনটি আর-রাশীদ করেছিলেন। মানুষ দেখতে পেত একজন ‘আলেমের  আত্মম্ভরিতাহীন সম্মান ও গুরুত্ব।

 

 

ফুটনোট

 

[১] তারতীবুল-মাদারিক (১/১৪৮), পৃঃ ১৩১-ও দ্রষ্টব্য

[২] আদ-দীবাজুল-মাযহাব (পৃঃ ১১৭), আল-আইম্মাতুল-আরবা’আহ: ড: আশ-শুক’আহ (পৃঃ ১৩)

[৩] তারতীবুল-মাদারিক

[৪] আল-আইম্মাতুল-আরবা’আহ: ড: আশ-শুক’আহ (পৃঃ ১৪)

[৫] আত-তামহীদ (৭/১৮৫), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৮/১০২)

[৬] আদ-দীবাজুল-মাযহাব (পৃঃ ১৯)

[৭] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৮/৬৩)

[৮] আদ-দীবাজুল-মাযহাব (পৃঃ ১৮)

[৯] তা’যীম কাদরিস-সালাহ (২/৬৬৯), হিল্‌য়াতুল-আওলিয়া (৬/৩১৮), তাহযীবুল-কামাল (২৭/১১০)