মূল লেখক: শায়খ ড: সালমান বিন ফাহ্দ আল-‘আওদাহ
ইমাম আবূ হানীফা বড় হয়েছিলেন একটি জ্ঞানমুখর পরিবেশে। এ পরিবেশ তাকে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়ানো থেকে তুলে এনে জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট হতে ও ‘উলামাদের বৈঠকে সময় কাটাতে সাহায্য করেছিলো একেবারে অল্প বয়সেই। এটা সম্ভব হয়েছিলো সেরকম কিছু ভালো মানুষের সহায়তায় যাদের সাথে তার সংসর্গ ছিলো, যারা তার মাঝে মেধা ও দুর্লভ গুণের সমাহার দেখেছিলেন। একারণেই ছোটদের ছোট বলে অবহেলা করা ঠিক না। তাদের ভালো উপদেশ দেয়ার ব্যাপারে বা সঠিক পথে চলার দিক নির্দেশনা দিতে কার্পণ্য করা উচিৎ নয়।
বংশপরিচয়
তার পুরো নাম: আবূ হানীফা আন-নু’মান বিন সাবিত বিন যূতা। যূতা ছিলো বনী তাইমের দাস। [১] তার পূর্বপুরুষদের বাস কী কাবুল, না বাবেল, না নাসা, না তিরমিয নাকি আম্বার? এ নিয়ে জীবনীকারদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। এদের কেউ কেউ চিন্তা করতে চেয়েছেন যে এই সকল স্থানেই তিনি জায়গা পরিবর্তন করেছেন বলে সবগুলোই তার নামের সাথে জুড়ে গেছে। বিষয়টি এত জটিল নয় অবশ্য।
আল-খাতীব বর্ণনা করেছেন ইসমা’ঈল বিন হাম্মাদ বিন আবী হানিফা (অর্থাৎ আবূ হানিফার নাতি) – নিকট থেকে যে ইসমা’ঈল বলেন: “ আমি হলাম ইসমা’ঈল বিন হাম্মাদ বিন আন-নু’মান বিন সাবিত বিন আল-মারযিবান। আমরা পারস্যের মুক্ত মানুষদের থেকে আগত। আল্লাহ্র শপথ আমাদের পায়ে কখনও দাসত্বের শেকল পড়েনি। আমার দাদা ৮০ সনে (হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। সাবিত (আবূ হানিফার বাবা) ‘আলী ইবন আবূ তালিবের (রা:) কাছে গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। তখন ‘আলী তার ও তার বংশধরদের জন্য বরকতের প্রার্থনা করে দু’আ করেছিলেন। আমরা আশা করি যে আমাদের জন্য ‘আলীর সেই দু’আ আল্লাহ্ তা’আলা গ্রহণ করেছেন”। [২]
আস-সিরাজ আল-হিন্দী ইসমা’ঈলের এই বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন: “ইসমা’ঈলের ভাইও এরকম কথাই বলেছে”। [৩]
জন্ম
আয-যাহাবী বলেন: “তিনি আশি সনে জন্মগ্রহণ করেন”। [৩] কারও কারও মতে সনটি ৬১ আবার কারও মতে সনটি ৬৩। আল-কুরাশী বলেন: “সঠিক মত হচ্ছে তিনি ৮০ সনে জন্মেছেন”। [৪]
আয-যাহাবী আরও বলেন: “তিনি ৮০ সনে বয়োকনিষ্ঠ সাহাবীদের জীবদ্দশায় জন্ম গ্রহণ করেন। আনাস বিন মালিককে (রা:) তিনি দেখেছেন যখন আনাস কূফায় আসেন, তবে তাদের কাছ থেকে তার (আবূ হানিফার) কোনও বর্ণনা প্রমাণিত নয়”। [৫]
‘আবদুল-কাদির আল-কুরাশী বলেন: “কেউ কেউ দাবী করে যে তিনি আটজন সাহাবীর কাছে থেকে তিনি শুনেছেন এবং এদের কেউ একটি অধ্যায়ে তাদের নামও জমা করেছে যা আমাদের কাছে পৌঁছেছে আমাদের শায়খদের কারও কারও কাছ থেকে। আমি নিজে একটি অধ্যায় রচনা করেছি এটি ব্যাখ্যা করে যে তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এতে আমি উল্লেখ করেছি কার কাছে তিনি শুনেছেন এবং কাকে তিনি দেখেছেন। আমি বলেছি আল-খাতীবের পক্ষ থেকে যে আবূ হানীফা আনাস বিন মালিককে দেখেছেন এবং যারা বলে যে তিনি আনাসকে দেখেননি তাদের কথা আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যাই দিয়েছি আমি”। [৬]
জ্ঞান অর্জন
আবূ হানিফা হাদীস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জনের দিকে ঝোঁকেন। তিনি তাবি’ঈদের (সাহাবীদের পরবর্তী প্রজন্ম) সবচেয়ে প্রখ্যাতদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ক্রমেই জ্ঞানের জগতে নৈপূণ্য প্রদর্শন করতে থাকেন এবং জ্ঞানী ইমামদের ইমামে পরিণত হন।
তবে তার ছোটকালেই কিন্তু অবস্থাটি এরকম ছিলো না। এসময় তিনি বাজারে বাজারে কেনাবেচার জন্য ঘোরাঘুরি করতেন। অতঃপর আশ-শা’বী তাকে উপদেশ দেন এবং পড়াশোনার দিকে তার মনোযোগ আকৃষ্ট করেন। আবূ হানিফা নিজেই তার এই পরিবর্তনের কথা বর্ণনা করেছেন: “আমি একবার আশ-শা’বীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বসেছিলেন এবং আমাকে ডাকলেন। বললেন: ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ বললাম: ‘বাজারে যাচ্ছি’। তিনি বললেন: ‘ঐ যাওয়ার কথা বুঝাইনি, বলছি যে ‘উলামাদের মাঝে কাদের কাছে যাও তুমি’।
আমি বললাম: ‘তাদের কাছে আমি কমই যাই’।
তিনি বললেন: ‘অবহেলা করো না। তোমার উচিৎ জ্ঞান অর্জন করা ও ‘উলামাদের সাথে বসার ব্যাপারে চিন্তা করা। আমি তোমার মাঝে একটি সচেতনতা ও গতিশীলতা লক্ষ্য করছি’।
তার এই কথাগুলো আমার মনে দাগ ফেলল। আমি বাজারে যাওয়া ছেড়ে দিলাম এবং জ্ঞান অর্জন করা শুরু করলাম। আল্লাহ তাকে দিয়ে আমার উপকার করলেন”।[৭]
ইমাম আবূ হানিফার জ্ঞান অর্জনের শুরুটা জানার জন্য আমরা তার নিজের কথাতেই ফিরে যেতে পারি। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কীভাবে তিনি জ্ঞান আহরণ শুরু করলেন।
তিনি বলেন: “আমি ছিলাম ‘ইলম ও ফিক্হের খনিতে। আমি জ্ঞানের এক পন্ডিতের সাথে বসতাম এবং বড় এক ফিকহ শাস্ত্রবিদের সাথে লেগে থাকতাম”। এখানে যে পন্ডিতটির সাথে লেগে থাকার কথা আবূ হানিফা বলছেন তিনি হলেন হাম্মাদ বিন আবূ সুলায়মান। আবূ হানীফা পুরো ১৮ বছর তার সাথে ছিলেন। মানুষের জানতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয় সেই ব্যক্তির ব্যাপারে যার সাথে আবূ হানীফার মতো একজন মহারথী প্রায় দুদশক অতিবাহিত করেছেন।
যাতে এই আল্লাহর অনুগ্রহসিক্ত সাহচর্য আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারি, আমরা আবার আবূ হানীফার নিজ মুখে বলা গল্পে ফিরে যাচ্ছি। এটা সেসময়ের কথা যখন তিনি ফিক্হ নিয়ে পড়বেন ঠিক করলেন এবং হাম্মাদের বৈঠকে বসা শুরু করলেন। শায়খ তার মাঝে স্মরণশক্তির প্রখরতা দেখতে পারলেন, জ্ঞানের প্রতি তার উন্মুখতা টের পেলেন।
ইমাম আবূ হানীফা বললেন: “আমি দশ বছর তার সাথে থাকলাম। অতঃপর আমার মাঝে একটু নেতৃত্বের বাসনা দেখা দিলো এবং আমি চাইলাম তার মজলিস থেকে সরে আমার নিজের বৈঠকে বসা শুরু করতে। তো একদিন সন্ধ্যায় আমি বের হলাম এবং ঠিক করলাম যে আমি এটাই করব। যখন মসজিদে ঢুকলাম এবং তাকে দেখলাম আমার তাকে ছেড়ে যেতে মন চাইলো না। ফলে আমি আবার গেলাম এবং তার কাছে বসলাম। সেই রাতেই খবর এলো যে বসরাতে তার এক আত্মীয় মারা গেছেন। আত্মীয়টি কিছু সম্পদ রেখে গেছেন এবং আমার শায়খ ছাড়া তার আর কোনও ওয়ারিশ নেই। তিনি আমাকে তার জায়গায় বসতে বললেন”।
এভাবে আবূ হানিফা তার শায়খের জায়গায় স্থান পেলেন সেই রাতেই যেদিন তিনি ঠিক করেছিলেন তাকে ছেড়ে যাবেন নিজের একার মজলিসের জন্য। মজার ব্যাপার হোলো যে সেটা তিনি ঠিকই পেলেন কিন্তু এজন্য তাকে ছাড়াছাড়ি করতে হোলো না। সেই উস্তাদেরই অনুমতিতে যাকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন সারা জীবন – যাকে তিনি শেষ মুহুর্ততক স্মরণ করেছেন। এমনকী যখন তিনি তার বাবামার জন্য দু’আ করতেন তখনও তিনি হাম্মাদকেও সেই দু’আয় শামিল করতে ভুলতেন না। তো আবূ হানীফা বসলেন পাঠ দিতে এবং ফাতওয়া দিতে (উস্তাদের অবর্তমানে)।
এসময় তার বয়স ছিলো মাত্র ৩০।
আবার তার মুখে শোনা যাক ঘটনা:
“তিনি তো গেলেন আর এদিকে আমার কাছে এমন সব প্রশ্ন আসা শুরু করলো যা আমি আগে কখনও শুনিনি। আমি জবাব দিতাম আর আমার উত্তর লিখে রাখতাম। তিনি দুমাস অনুপস্থিত থেকে ফিরলেন। আমি তাকে আমার জবাবগুলো দেখালাম, ৬০টির মতো প্রশ্ন ছিলো। তিনি ৪০টিতে আমার সাথে একমত হলেন আর ২০টিতে দ্বিমত পোষণ করলেন। আমি তখন মনঃস্থির করলাম যে তার মৃত্যু অবধি তার কাছ থেকে সরবো না। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তার কাছ থেকে সরিনি”। [৮]
এধরণের ঘটনাকে এমনি এমনি যেতে দেয়া মোটেই সমীচীণ নয়। প্রতিটি ‘ইলম অন্বেষণকারীর জীবনে এটি একটি দরকারী শিক্ষা হয়ে থাকা দরকার। তার পরিকল্পনায় ও পথ চলায় এটি সংবিধান হয়ে থাকা উচিৎ। জ্ঞানের সাগর অতিদীর্ঘ। এর গভীরতা অতলস্পর্শী। তীরসমূহ দূরদূরান্তে বিস্তৃত। এই পথ পাড়ি দেয়ার জন্য দরকার আদর্শের, উস্তাদের, অনুসরণের, বিনম্রতার এবং স্থিতিশীলতার। তা না হলে অবস্থা হবে পানির বুদবুদের মতো। অল্প যেটুকু সময় তার অস্তিত্ব ততক্ষণই তার যা পাওয়া। তার কোনও চিহ্ন থেকে যাবে না। হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে কোনও কাজের কাজ না করেই। [৯]
বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র
আবূ হানীফা সুন্দর চেহারার মানুষ ছিলেন – অত্যন্ত সুদর্শন বলতে হবে তাকে। কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে চৌকস। ভালো পোশাক ও সুগন্ধির দিকে তার ভালো ঝোঁক ছিলো। তার ব্যাপারে এভাবে বর্ণনা এসেছে: “তিনি ছিলেন মানুষের মাঝে দেখতে সবচেয়ে সুদর্শন, কথায় সবচেয়ে বাগ্মী, গলার স্বরে সবচেয়ে শ্রুতিমধুর এবং তার যা বলার ছিলো তা প্রকাশে সবচেয়ে সচ্ছন্দ”। [১০]
ইয়াহইয়া আল-কাত্তান বলেন: “আল্লাহ্র শপথ আমরা আবূ হানীফার সাথে বসেছি এবং তার কথা শুনেছি। আল্লাহ্র শপথ যখনই আমি তার দিকে তাকাতাম তার চেহারা দেখে বুঝতে পেতাম যে তিনি আল্লাহ্কে ভয় করেন”। [১১]
আবূ ইউসুফ খলীফা হারুন আর-রাশীদকে আবূ হা্নীফার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: “আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “সে কোনও কথাই উচ্চারণ করে না যার জন্য তার নিকটে এক তৎপর প্রখর প্রহরী নেই”। [সূরা কাফ: ১৮]।
সব বক্তার জন্যই এই প্রহরী রয়েছেন। আবূ হা্নীফার ব্যাপারে আমি যা জানি তা হোলো যে তিনি আল্লাহ্র নিষেধ বা হারাম কাজগুলো লঙ্ঘিত হওয়ার ব্যাপারে ছিলেন প্রচন্ড সতর্ক। আল্লাহ্র দীনের ব্যাপারে জানা নেই এমন কিছু বলার ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী। আল্লাহ্র আনুগত্যকে ভালোবাসতেন, অবাধ্যতাকে অপছন্দ করতেন। দুনিয়ায় মশগুল হয়ে পড়া মানুষদের এড়িয়ে চলতেন, দুনিয়ার জাঁকজমক নিয়ে প্রতিযোগিতা করতেন না। দীর্ঘ নিরবতা পালন করতেন, চিন্তাশীল থাকতেন সর্বক্ষণ – তার বিস্তৃত জ্ঞানের ওপর ভর করে। ভুল বকতেন না বা বকবক করতেন না। যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হতো যার ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিলো – তিনি তা বলতেন এবং যা শুনেছেন তার ওপর ভিত্তি করে জবাব দিতেন। আর যদি প্রত্যক্ষ জ্ঞান তার না থাকতো, তিনি কিয়াস করতেন হকের ওপর ভর করে এবং সেটা অনুসরণ করতেন – নিজেকে এবং নিজের দীনকে সামলে। জ্ঞান ও অর্থ বিতরণে ছিলেন অকৃপণ। নিজেকে অন্যদের কাছে হাত পাতা থেকে মুক্ত রাখতেন। লোভ করতেন না, গীবত থেকে দূরে থাকতেন। কারও ব্যাপারে ভালো ছাড়া কিছু বলতেন না”।
এ কথা শুনে আর-রাশীদ বললেন: “এ হচ্ছে সৎকর্মশীলদের চরিত্র”।
এরপর তিনি তার লেখককে বললেন: “এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো লিখে রাখো এবং আমার ছেলের কাছে পাঠাও, সে যেন দেখে”। [১২]
আবূ হানীফা ছিলেন ফিক্হ শাস্ত্রে অত্যন্ত ঝানু ব্যক্তি। তার ধর্মভীরুতা ছিলো নাম করা। ভালো সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তার আশে পাশের মানুষদের দান করার ব্যাপারে তার খ্যাতি ছিলো। দিন রাত ধরে শিক্ষকতা করে যেতেন ধৈর্য সহকারে। শান্ত সৌম্য মানুষ, চুপ থাকতেন। অল্প বলিয়ে মানুষ – হালাল হারামের প্রশ্ন উত্থাপিত না হলে বেশি কথা বলতেন না। সত্যের দিকে নির্দেশ করার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন, শাসকদের উপঢৌকন থেকে দূরে থাকতেন।[১৩]
‘আবদুল্লাহ ইবনুল-মুবারাক (র:) বলেন: “বৈঠকে আবূ হানীফার চেয়ে গাম্ভীর্যময় কাউকে আমি দেখিনি, যেমন দেখিনি তার চেয়ে সৌম্য ও ধৈর্যশীল কাউকে”।[১৪]
হিজ্র ‘আবদুর-রাযযাক (র:) বলেন: “মানুষ আবূ হানীফার চেয়ে দিলখোলা কোনও সঙ্গী দেখেনি, এবং সহচরদের সাথে এতটা সম্মান দেখানো কাউকেও দেখেনি”। [১৫]
প্রচন্ড সহিষ্ণু ছিলেন, মূর্খরা তাকে খেপিয়ে তুলতে পারত না, বা তার মাথার ওপর চড়েও বসতে পারত না।
‘আবদুর-রাযযাক (র:) বলেন: “আমি আবূ হানীফাকে খায়ফের মসজিদে দেখেছি। এক ব্যক্তি তাকে এসে একটি প্রশ্ন করলেন এবং তিনি জবাব দিলেন। তখন সেই ব্যক্তি তাকে বলল: ‘কিন্তু হাসান তো এই এই বলেছেন’।
আবূ হানীফা বললেন: ‘হাসান ভুল করেছেন’।
তখন মুখ ঢাকা এক ব্যক্তি এসে বলে বসল: ‘তুমি হাসানের ভুল ধর, ওরে _____ পোলা (আবু হানীফার মাকে গালি দিয়ে)’।
তারপর সে চলে গেল। আবূ হানিফার মুখে কোনও ভাবান্তর হোলো না। তিনি কেবল বললেন: ‘হাসান ভুল করেছেন এবং ইবন মাস’উদ ঠিক বলেছেন”।[১৬]
সাহ্ল বিন মুযাহিম বলেন: “আমি আবূ হানীফাকে বলতে শুনেছি: ‘আর সুসংবাদ দাও বান্দাদের, যারা কথা শোনে ও ভালোটা অনুসরণ করে’ [আয-যুমার: ১৭-১৮]। এরপর তিনি প্রায়ই বলতেন: “হে আল্লাহ্! আমাদের ব্যাপারে যার হৃদয় শক্ত হয়ে গেছে, আমাদের হৃদয় কিন্তু তার জন্য প্রশস্ত”। [১৭]
ইয়াযীদ বিন কুমায়ত বলেন: “এক ব্যক্তি এসে আবূ হানীফাকে বললেন: ‘আল্লাহকে ভয় করো!’ এতে আবূ হানীফা কেঁপে উঠলেন, তার চেহারা হলুদ হয়ে গেল এবং তিনি বললেন: “আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। প্রতিটি সময়ই মানুষের এরকম কারও কতই না দরকার যে তাকে এ ধরণের কথা বলবে”।[১৮]
আবূ হানীফা নিজে বলতেন: “হাম্মাদ মৃত্যু বরণ করার পর থেকে আমি একটি সালাতও আদায় করিনি আমার বাবা-মার পাশে তার জন্য দু’আ না করে। আমি অবশ্যই মাগফেরাত প্রার্থনা করি যার কাছে ‘ইলম নিয়েছি এবং যাকে ‘ইলম দিয়েছি তার জন্য”। [১৯]
এই হচ্ছে সেই তারবিয়াহ যা থেকে জ্ঞানের উন্মেষ হয়। জ্ঞান ও সহিষ্ণুতার যে জোড় – এরচেয়ে সুন্দর জুড়ি আর কোথাও মিলবে না। জ্ঞানীদের মাঝে মতভেদ সবসময়ই ছিলো। ছাত্ররা কখনও কখনও অমুক তমুক শায়খকে নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়। এতে তারা নির্দিষ্ট কোনও শায়খের হৃদয়কে বিষিয়ে তোলে, শুরু হয় দূরত্ব। আবার কোনও কোনও জ্ঞানী মূর্খ ও নির্বোধদের সাথে বিতর্কে ও শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে যান যার ফলে তাদের নিজেদের অবস্থাই প্রকাশ পেয়ে যায়। কেননা তাদের মূল কাজ হচ্ছে ‘ইলম হাসিল করা, ফিক্হ বের করা এবং প্রমাণ দেয়া। গালিগালাজ, কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি তাদের লক্ষ্য হতে পারে না।
তার ইবাদাত
সুফ্য়ান বিন ‘উয়ায়নাহ বলেন: “আমাদের সময়ে আবূ হানীফার চেয়ে বেশি সালাত আদায় করা কোনও ব্যক্তি মক্কায় আসেনি”।[১]
আবূ ‘আসিম আন-নাবীল বলেন: “আবূ হানীফাকে ‘খুঁটি’ নাম দেয়া হয়েছিলো তার অধিক সালাতের জন্য”।[২]
আবূ মুতী’ (র:) বলেন: “আমি মক্কায় ছিলাম। রাতের যে সময়ই আমি কা’বায় তাওয়াফ করার জন্য ঢুকতাম দেখতাম আবূ হানীফা ও সুফ্য়ান তাওয়াফ করছেন”।[৩]
আসাদ বিন ‘আমর বলেন: “আবূ হানীফা ৪০ বছর ‘ঈশার সালাতের অজু দিয়ে ফজর সালাত পড়েছেন। তিনি পুরো রাত এক একটি রাক’আতে পুরো কুরআন পড়ে শেষ করতেন। রাতে তার ক্রন্দনের এত আওয়াজ পাওয়া যেত যে প্রতিবেশীদের তার জন্য মায়া লেগে যেত। এও জানা গেছে যে জায়গায় তিনি মারা যান সেখানে তিনি ৭০ হাজার বার কুরআন খতম করেছেন”।[৪]
আবূ হানীফার পুত্রদের একজন বলেন: “আমার বাবা যখন মারা গেলেন আমরা হাসান বিন ‘আম্মারাহকে বললাম তার গোসল দিতে, তিনি তা করলেন। যখন তিনি গোসল দিচ্ছিলেন, বলছিলেন: “আল্লাহ্ তোমাকে রহম করুন এবং মাফ করে দিক। ত্রিশ বছর ধরে তুমি রোজা ভাঙ্গোনি, চল্লিশ বছর ধরে তুমি ভালো করে ঘুমোওনি রাতে। তোমার পরবর্তীদের তুমি হয়রান করে দিয়েছ আর ‘ইবাদাতকারীদের চেহারা প্রকাশ করে দিয়েছ”।[৫]
সত্যি কথা হোলো যে আসলে এই বর্ণনাগুলোতে কিছু বাড়াবাড়ি চলে এসেছে। পুরো রাত জেগে থাকাটা শরী’আ সমর্থিত নয়। আল্লাহ তা’আলা তার নবীকে (সা:) কুরআনে বলছেন: “রাত্রিবেলা তুমি উঠে দাঁড়াও অল্প কিছু সময় ব্যতীত, অথবা এর থেকে কিছু কমিয়ে বা বাড়িয়ে নাও এবং কুরআন আবৃত্তি করো ধীরস্থির ভঙ্গীতে”। [সূরা আল-মুয্যাম্মিল: ২-৪]
সাহাবীদের বর্ণনা অনুসারে নবীজী (সা:) রাতে জাগতেন আবার ঘুমোতেন ঠিকই। যেমনটি ইবন ‘আব্বাস, হুযায়ফাহ, ‘আইশা ও অন্যান্যদের হাদীসে এসেছে।
আর এক রাক’আতে কুরআন পুরোটা পড়ে ফেলা খুবই অদ্ভুত এবং কষ্টকর কথা। এ ধরণের কাজ নবীজী (সা:) বা তার সাহাবীদের কাছ থেকে আসেনি – তবে এরকমটা ‘উসমান (রা:) করেছিলেন বলে একটি খবর পাওয়া যায় যদি সেটা সত্যি হয়ে থাকে। আর ৭০ হাজার বার কুরআন পড়ে শেষ করতে হলে ২০০ বছর ধরে টানা প্রতিদিন একবার করে অন্তত কুরআন পড়ে শেষ করতে হবে কোনোরকম বিরতি না রেখে – শিশুকাল, অসুখবিসুখের তোয়াক্কা না করে। এটা অসম্ভব। তবে যারা জীবনীকার ছিলেন তাদের একটি অভ্যাস ছিলো যাই বর্ণিত হয়েছে তাই এনে জমা করতে – অনেক সময় কোনও তদন্ত ছাড়াই।
এধরণের বর্ণনা তালিকাভুক্ত করার সময় মনে হয় এটা চিন্তা করা হয়নি যে এগুলো মানুষের লক্ষ্যকে দমিয়ে দেবে এবং তাদের সংকল্প দূর্বল করে দেবে। পথের বন্ধুরতা সেই পথে চলার মানুষ কমিয়ে দেয় এবং একে পরিহার করে চলা লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। এখানে তাই আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলদের ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে তার ব্যাপারে একটি খেয়াল করার বিষয় রয়েছে। এসব বর্ণনার কিছু আছে যার আসলে কোনও ভিত্তি নেই, যা বর্ণনাকারীদের অতিরঞ্জন মাত্র। অথবা আসলে বর্ণনাকারী আধিক্য বোঝাতে চেয়েছেন, আক্ষরিক অর্থে নির্দিষ্ট সংখ্যা বোঝাতে চাননি। আবার কিছু বর্ণনা আছে যা সহীহ কিন্তু এতে বর্ণিত কাজটি শরি’আ দ্বারা উৎসাহিত নয়।
পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা উচিৎ কেবল আল্লাহ্র রাসূলকে (সা:), যেমনটি আমাদের রব্ব সুবহানাহু বলেছেন: “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের মাঝে রয়েছে সন্দেহাতীতভাবে একটি উত্তম আদর্শ – তার জন্য যে আল্লাহ্কে ও কেয়ামতের দিবসকে আকাঙ্ক্ষা করে এবং আল্লাহ্কে স্মরণ করে অনেক বেশি”। [সূরা আল-আহযাব: ২১]
তার সংযম ও ধার্মিকতা
আবূ হানীফা ছিলেন সংযম ও ধার্মিকতায় একজন ইমাম এবং সকল সংযমী সাধকরাই এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র:) বলেন: “তিনি ছিলেন জ্ঞানে, সংযমে, ধার্মিকতায় ও আখিরাতের জীবনের প্রতি ভালবাসায় অটল”।[৭]
‘আব্দুল্লাহ ইবনুল-মুবারাক (র:) বলেন: “আমি আবূ হানিফার মতো ধার্মিকতা কারও মাঝে দেখিনি, তার এই ধার্মিকতা প্রহার এবং অর্থকড়ি উভয় দিয়েই পরীক্ষিত”।[৮]
ইবন জুরায়জ (র:) বলেন: আমার কাছে খবর এসেছে কূফার ফাকীহ আন-নু’মান (আবূ হানীফা) অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি, তিনি নিজের ধর্ম ও জ্ঞানকে বাঁচিয়ে চলেন। দুনিয়ার লোকদের তিনি আখিরাতের লোকদের চেয়ে বেশি পাত্তা দেন না”।[৯]
দুনিয়াকে আবূ হানীফার পায়ে বিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো কিন্তু তিনি তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেননি। এই দুনিয়াকে না ধরার জন্যই তিনি প্রহৃত হয়েছিলেন তাও তিনি তাকে গ্রহণ করেননি। [১০]
ইয়াযীদ বিন হারুন বলেন: “আমি বহু মানুষ দেখেছি কিন্তু আবূ হানীফার চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান, উত্তম, ধার্মিক কাউকে পাইনি”।[১১]
আয-যাহাবী (র:) বলেন: তিনি ছিলেন ইমাম, ‘আলেম, আমলদার এবং ‘ইবাদাতকারী। বৃহৎ চিন্তায় তিনি ছিলেন নিমজ্জিত। শাসকদের উপঢৌকন তিনি গ্রহণ করতেন না”।[১২]
তার ধার্মিকতার উদাহরণ
হাফ্স বিন ‘আব্দুর রাহমান ছিলেন আবূ হানীফার ব্যবসায়ের অংশীদার। আবূ হানীফার কাজ ছিলো হাফ্সের জন্য পণ্য সাজিয়ে দেয়া। তো তিনি হাফ্সের কাছে পণ্য পাঠালেন এবং তাকে জানানোর ব্যবস্থা করলেন যে কাপড়ে (যা তার পণ্য) এই এই সমস্যা আছে। অতএব তুমি বিক্রি করার সময় এটা বলে দিও। হাফ্স সেই পণ্য বিক্রি করলেন কিন্তু ত্রুটির কথা বর্ণনা করতে ভুলে গেলেন। ওদিকে কার কাছে বিক্রি করেছেন তার পরিচয়ও রাখা হয়নি। যখন আবূ হানীফার কাছে এই খবর এসে পৌঁছলো তিনি সেই কাপড়ের দাম পুরোটাই দান করে দিলেন।[১৩]
এটি ছিলো তার মহাকীর্তিগুলোর একটি যাতে প্রমাণিত হয় যে জ্ঞানত তিনি দুনিয়ার রসনা আস্বাদনে ব্যস্ত ছিলেন না। অন্যদিকে তার জ্ঞানার্জন তাকে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং হালাল রুজি অর্জনে বাধা দেয়নি। এটিই হোলো সাহাবীদের ও সৎকর্মশীলদের দেখানো পথ, যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু তাদের বর্ণনা করেছেন: “সেই মানুষেরা – ব্যবসায় ও বিকিকিনি তাদের বিরত রাখতে পারে না আল্লাহ্র স্মরণ থেকে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত আদায় করা থেকে, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন হৃদয় ও চক্ষু আন্দোলিত হবে”। [সূরা আন-নূর: ৩৭]। তারা ব্যবসায়-বাণিজ্যের মানুষ ছিলেন বটে। কিন্তু সেগুলো তাদের আল্লাহ্র স্মরণ, সালাত প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
এদের সামনে কোথায় সে ব্যক্তি যে তার জ্ঞানকে যে কোনও ভাবে মাল হাসিলের পথ বানিয়ে নিয়েছে ?! অথবা সে যে কীনা দাবী করে সে জ্ঞানার্জনের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে অথচ তার মন পড়ে থাকে মানুষের দিকে ও তাদের কাছে চাওয়ার উদ্দেশ্যে?! অথবা সেই ব্যক্তি যে কীনা বড় গলায় দাবী করে যে সে দুনিয়াকে পাত্তা দেয় না এবং দুনিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করে না অথচ ঠিকই তার সর্বস্ব বিনিয়োগ করে পাত্তিওয়ালা ও ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে তার আখের গুছিয়ে নিতে?!
আবূ হানীফা ও বিচারকের পদ
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের একটি উক্তি আগেই উল্লিখিত হয়েছে: “তিনি ছিলেন জ্ঞানে, সংযমে, ধার্মিকতায় ওআখিরাতের জীবনের প্রতি ভালবাসায় অটল”। তিনি আবূ জা’ফর আল-মানসূরের অধীনে কাদীর (বিচারক) পদ নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে প্রহার করা হয়, কিন্তু তবুও তিনি তা করেননি। আল্লাহ্ তার ওপর তার করুণা বর্ষণ করুন।[১৪]
ইয়াহইয়া বিন মা’ঈন (র:) বলেন: “আমাদের কাছে আবূ হানীফা সত্যবাদী পুরুষদের একজন, মিথ্যেবাদিতার অভিযোগ তার ওপর নেই। ইবন হুবায়রাহ তাকে বিচারকের কাজ গ্রহণ না করার জন্য প্রহার করেন। কিন্তু তিনি বিচারক হতে অস্বীকৃতি জানান”।[১৫]
‘উবায়দুল্লাহ বিন ‘আমর বলেন: “ইবন হুবায়রাহ আবূ হানীফাকে কূফার বিচারকের পদ নিতে বলেন। তিনি অস্বীকৃতি জানান। ফলে তাকে ১১০টি বেত্রাঘাত করা হয়, প্রতিদিন ১০টি করে। তিনি মোটেই রাজি হননি। যখন ইবন হুবায়রাহ দেখলেন যে আবূ হানীফা বদ্ধপরিকর তখন তাকে ছেড়ে দিলেন”।[১৬]
ইসমা’ঈল বিন সালেম আল-বাগদাদী বলেন: “আবূ হানীফাকে বিচারকের পদ নিতে বাধ্য করার জন্য প্রহার করা হয়েছিলো কিন্তু তিনি তা নেননি। আহমাদ বিন হাম্বলের কাছে যখন এই ঘটনা উল্লেখ করা হতো তিনি কাঁদতেন এবং আবূ হানীফার জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এটা আহমাদ নিজে প্রহৃত হওয়ার পরের ঘটনা”।[১৭]
যেসব ইমামরা বিচারক হওয়ার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি চাইতেন তারা এটা করতেন এই কারণে যে তারা নিজেদের সেই পদের যোগ্য মনে করতেন না, অথবা অন্য কোনও নির্দিষ্ট কারণে চাইতেন না। তা নাহলে মানুষের তো বিচারক একজন লাগবেই। বহু বিখ্যাত ‘উলামা ও ইমামগণ আবার বিচারকের পদ নিয়েছেনও। যেমনটি ওয়াকী’ বা অন্যান্যরা কাদীদের কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন।
তার ব্যবসায় ও পেশা
ইমাম আবূ হানীফা ছিলেন বিত্তবান ব্যক্তি ও কাজের মানুষদের একজন যারা ঘাম ঝড়িয়ে উপার্জন করেন। তিনি সিল্ক বিক্রি করতেন এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের ওপর ব্যয় করতেন। অভাবীদের জন্য তার হাত সবসময়ই খোলা থাকতো।
‘উমার বিন হাম্মাদ বিন আবূ হানীফা বলেন: “আবূ হানীফা ছিলেন রেশম বিক্রেতা, দার ‘আমর বিন হারিসে তার দোকান বেশ পরিচিত ছিলো”।[১৮]
আবূ নু’আয়ম আল-ফাদ্ল বলেন: “আবূ হানীফা ছিলেন তার আশে পাশের মানুষদের জন্য খুবই মুক্তহস্ত এবং দরদী মানুষ”।[১৯]
ফুদায়ল বিন ‘আয়্যাদ বলেন: “আবূ হানীফা ছিলেন বিত্তশালী ব্যক্তি, কাছের মানুষদের দান করার ব্যাপারে তিনি বিখ্যাত ছিলেন”।[২০]
তিনি তার পণ্যসামগ্রী বাগদাদে পাঠাতেন, তা দিয়ে জিনিসপত্র কিনে কূফায় রাখতেন। তার মুনাফা তিনি বছর থেকে বছর জমিয়ে রাখতেন। অতঃপর তা দিয়ে অন্যান্য শায়খ ও মুহাদ্দিসদের দরকারী জিনিস, খাদ্য এবং পোশাক আসাক কিনতেন। এরপর যেসব দিনার বেঁচে থাকতো তা নগদ তাদের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন: “তোমাদের দরকারে কাজে লাগাও এবং আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে প্রশংসা করো না। আমি তো আমার সম্পদ থেকে কিছুই তোমাদের দিইনি। বরং আমার ওপর আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে দিয়েছি। সুতরাং এগুলো তোমাদেরই মুনাফা”।
বাজারের লেনদেনগুলো যেন এমনই যার ব্যাপারে ‘উমার নিজেকে নিয়ে বলেছিলেন যখন তিনি জানলেন আল্লাহ্র রাসূলের একটি হাদীস তার অজানা ছিলো: “আল্লাহ্র রাসূলের আদেশ থেকে এটি আমার কাছে গোপন থেকে গেছে, বাজারের বিকিকিনি আমাকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছিলো”। [২১] আবূ হানীফা, ইবনুল-মুবারাক ও অন্যান্য ইমামদের জীবনী আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই কথা যা আয-যুহরী তার ভাই ‘আবদুল্লাহকে বলেছিলেন। তিনি যখন দেখলেন ভাই ‘আবদুল্লাহ রিযকের সন্ধানে বাক্স-প্যাঁটরা বাঁধছে তিনি বললেন: (মূল লেখায় পদ্য ছিলো, আমি গদ্যে অনুবাদ করছি)
“যখন আমি ‘আব্দুল্লাহকে দেখলাম, সে তো চকচকে মুখে তার সামান বাঁধছিলো। বললাম দুনিয়ার গুপ্তধন অনুসন্ধান করো আর প্রার্থনা করো আল্লাহ্র। হয়তো একদিন তোমার প্রার্থনার জবাব পাবে এবং পেয়ে যাবে তোমার যা ঈপ্সিত। তোমাকে তিনি দেবেন বিস্তৃত ঐশ্বর্য যেভাবে পৃথিবীর জল নেমে আসে বিপুল বেগে”। [২২]
ফুটনোট
[১] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৫৩)
[২] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০০)
[৩] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৫৩)
[৪] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৪)
[৫] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৫), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২)
[৬] মুসান্নাফ ‘আব্দুর-রায্যাক (৫৯৫২)। সুনান আল-বায়হাকী আল-কুবরা (৩৮৬৫)
[৭] ‘উকূদুল-জামান (পৃঃ ১৯৩)
[৮] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৭)
[৯] আখবার আবী হানীফা ওয়া-আসহাবিহি (পৃঃ ৩২-৩৩)
[১০] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৩৭)
[১১] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৮)
[১২] তাযকিরাতুল-হুফ্ফায (১/১৬৮)
[১৩] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৭), তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৫৮), আখবার আবী হানীফা ওয়া-আসহাবিহি (পৃঃ ৪৬)
[১৪] ‘উকূদুল-জামান (পৃঃ ১৯৩)
[১৫] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪২৪), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৩৯৫)
[১৬] তাহযীবুল কামাল (২৯/৪৩৭), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২), তারীখ বাগদাদ (১৩/৩২৬)
[১৭] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩২৭), আখবার আবী হানীফা (পৃঃ ৬৭)
[১৮] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৩৯৪)
[১৯] আখবার আবী হানীফা ওয়া-আসহাবিহি (পৃঃ ২)
[২০] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪০)
[২১] মুসলিম (২১৫৩)
[২২] আয-যুহরীর কবিতার পঙক্তিসমূহ। আল-মারযিবানীর মু’জামুশ-শু’আরা-তে সংরক্ষিত।
তার ফিক্হ
আবূ হানীফা ছিলেন ফিক্হ (ইসলামি বিধান শাস্ত্র) ও কিয়াস (নতুন সমস্যায় পুরনো সমাধানের আলোকে তুলনামূলক বিচার পদ্ধতি, juristic analogy) শাস্ত্রে একজন ইমাম। এই দুই বিষয়ে তার কথা কবিতার চেয়েও সূক্ষ্ণ। বহু ‘উলামার বক্তব্য এসেছে এ ব্যাপারে তার অগ্রগামিতা ও ধীশক্তির প্রশংসা করে।
ইমাম আশ-শাফি’ঈ (র:) বলেন: “মানুষ ফিক্হ শাস্ত্রের ক্ষেত্রে আবূ হানীফার ওপর নির্ভরশীল।”[১]
আয-যাহাবী এর সাথে যোগ করে বলেন: “ফিক্হের ইমামতি ও সূক্ষ্ণতা এই ইমামের কাছে অর্পণ করে দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। সেই বুদ্ধিতে কিছুই ধরবে না যদি দিবসকেও তার প্রমাণ দিতে হয়! [২]
ইবনুল-মুবারাক বলেন: “মানুষের মাঝে ফিক্হ শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ আবূ হানীফা। আমি ফিক্হে তার মতো কাউকে দেখিনি”।[৪]
তিনি আরও বলেন: “যদি কোনও বর্ণনা (أثر) বুঝতে মতের দরকার হয়ই তবে মালিক, সুফ্য়ান ও আবূ হানীফার মত (গ্রহণযোগ্য)। আবূ হানীফা তাদের মাঝে সবচেয়ে ভালো, বোধের দিক থেকে সূক্ষ্ণতর এবং তাদের মাঝে তিনি ফিক্হ বোঝায় বেশি গভীর। ফিক্হ শাস্ত্রে তিনিই তিনজনের মাঝে সেরা”।[৪]
ইবনুল-মুবারাক আরও বলেন: “আমি মুসা’ইরকে দেখেছি আবূ হানীফার মজলিসে তার কাছে বসে জিজ্ঞেস করতে এবং ফায়দা নিতে। আমি ফিক্হ শাস্ত্রে আবূ হানীফার চেয়ে ভালো কাউকে কথা বলতে দেখিনি”।[৫]
আবূ হানীফার ছাত্র আবূ ইউসুফ (র:) বলেন: “আমি আবূ হানীফার চেয়ে হাদীসের ব্যাখ্যায় ও বচনসমূহের, যাতে ফিক্হের জ্ঞান নিহিত আছে, ব্যাখ্যায় আবূ হানীফার চেয়ে ভালো কাউকে পাইনি।”[৬]
শু’বাহ বিন আল-হাজ্জাজ যখন আবূ হানীফার মৃত্যুর কথা শোনেন, বলেন: “তার সাথে কূফার ফিক্হও চলে গেল। আল্লাহ্ আমাদের ওপর ও তার ওপর করুণা বর্ষণ করুন।”[৭]আন-নাদ্র বিন শুমায়েল (র:) বলেন: “মানুষ ফিক্হ শাস্ত্রে ঘুমিয়ে ছিলো। আবূ হানীফা ফিক্হকে ভেঙ্গে, ব্যাখ্যা করে ও সংক্ষিপ্ত করে তাকে জাগালেন।”[৮]
যখন ইয়াযীদ বিন হারুনকে জিজ্ঞেস করা হোলো, ফিক্হে কে বেশি পারদর্শী: আবূ হানীফা নাকি সুফ্য়ান? তিনি বললেন: “সুফ্য়ান হাদীস সংরক্ষণে বেশি পারঙ্গম, আবূ হানীফা ফিক্হে।”[৯]
ইবনুল-মুবারাক (র:) বলেন: “যদি কোনও একজন ব্যক্তিরও নিজের মত পোষণের কোনও অধিকার থেকে থাকে তবে আবূ হানীফার নিজের মত প্রদানের অধিকার আছে।”[১০]
মুহাম্মাদ বিন বিশ্র (র:) বলেন: “আমি আবূ হানীফা ও সুফ্য়ান উভয়ের কাছেই যেতাম। তো আবূ হানীফার কাছে গেছি, তিনি বললেন: ‘কোথা থেকে এসেছ?’ আমি বললাম সুফ্য়ানের কাছ থেকে। তিনি বললেন: ‘তুমি এমন এক লোকের কাছ থেকে এসেছ যদি ‘আলকামাহ্ ও আল-আসওয়াদ আজ থাকতেন তাদেরও তার মতো কাউকে দরকার হতো।’ এরপর আমি সুফ্য়ানের কাছে গেলাম, তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘কোথা থেকে এসেছ?’ আমি বললাম: ‘আবূ হানীফার কাছ থেকে।’ তিনি বললেন: ‘তুমি পৃথিবীতে ফিক্হ শাস্ত্রে সবচেয়ে পারদর্শী মানুষের কাছ থেকে এসেছ।'”[১১]
ইয়াহইয়া বিন মা’ঈন বলেন, আমি ইয়াহইয়া বিন সা’ঈদ আল-কাত্তানকে বলতে শুনেছি: “আমরা আল্লাহ্কে অস্বীকার করি না। আবূ হানীফার মতের চেয়ে ভালো কিছু আমরা শুনিনি, তার বেশিরভাগ কথাই আমরা গ্রহণ করেছি।”
তিনি আরও বলেন: “ইয়াহইয়া বিন সা’ঈদ ফাতওয়া নিতে কূফাবাসীদের কথার দিকে ভিড়তেন। তিনি অন্যদের কথার চেয়ে আবূ হানীফার কথাকে পছন্দ করতেন এবং তার রায়কে তার সঙ্গীদের রায়ের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতেন।”[১২]
‘আব্দুর রায্যাক আস-সান’আনী (র:) বলেন: “আমি মু’আম্মারের সাথে ছিলাম, তো তার কাছে ইবনুল-মুবারাক এলেন। আমরা শুনলাম যে মু’আম্মার বলছেন: ‘যারা নাজাতের বাসিন্দাদের জন্য ফিক্হ নিয়ে সুন্দর করে বলতে পারে, কিয়াস করতে পারে এবং ফিক্হ বুঝিয়ে দিতে পারে তাদের মাঝে আবূ হানীফার চেয়ে বড় বোদ্ধা আর কাউকে চিনি না, যেমন আমি চিনি না আবূ হানীফার চেয়ে আল্লাহ্র দীনের ভেতর কোনও সন্দেহজনক জিনিস ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে নিজের ব্যাপারে সবচেয়ে ভয় করনেওয়ালা কাউকে।”[১৩]
আয-যাহাবী (র:) বলেন: “যদি ফিক্হ, মতের সূক্ষ্ণতা ও এর গভীরতার কথা হয় তাহলে তিনি (আবূ হানীফা) হচ্ছেন এর শেষ কথা। মানুষ এ ব্যাপারে তার ওপর নির্ভরশীল।”[১৪]
ইমাম আবূ হানীফা কূফা নগরে রায় প্রদান বা ফিক্হি ইস্যুতে মত প্রদানের মাদ্রাসা চালু করেন। এর মাধ্যমে তিনি তাজদীদ (নবায়ন) ও কিয়াসের যে প্রয়োজন, যা মানুষের জীবনে নিত্যনতুন সমস্যার আলোকে দেখা দিয়েছিলো, তা পূরণ করেন। বিশেষ করে তাদের নিকট হাদীসের বর্ণনায় ঘাটতি থাকায় এই প্রয়োজন ছিলো আরও প্রকট। এটা করতে গিয়ে তিনি তাদের কাছে বৈরী মনোভাব পান যাদের ‘আক্ল তার ‘আক্লের মতো প্রশস্ত ছিলো না এবং তিনি যা বুঝতে পেরেছিলেন তা বুঝতো না। কেবলমাত্র যখন তিনি এই মাদ্রাসাকে ঠিকমতো দাঁড় করালেন এবং এর নীতিমালা নির্ধারণ করলেন তখনই বহু বিরোধী ব্যক্তি মেনে নেয়া শুরু করলো একে। বাকিরা নিজেদের গুটিয়ে রাখল এবং এ নিয়ে প্রায় কথা বলা বন্ধ করে দিলো। এটা ঐতিহাসিক ভাবে বিভিন্ন চিন্তাধারার সাথেই হয়েছে যেমনটি আপনি দেখবেন ভাষার নীতিশাস্ত্র, উসূল ইত্যাদি বিষয়ক স্কুল অফ থ্যটে।
ইমাম আহমাদ (র:) কী চমৎকার মানুষই ছিলেন! তিনি বললেন: “আমরা আহলে রায়-দের অভিসম্পাত দিতাম এবং তারা দিত আমাদের যতক্ষণ না আশ-শাফি’ঈ এসে আমাদের মাঝে মিটমাট করলেন।”[১৫]
ইসহাক এবং অন্যান্যরা এরকমই বলেছেন: “তাদের এ নিয়ে একটা ইস্যু চলছিলো যদিও অবশেষে আবূ হানীফার বহু সমাধান তারা গ্রহণ করা শুরু করলেন।”
ইনসাফকারীরা এমনটিই করে থাকেন: সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন কোনও রকম বিদ্বেষ বা আত্মম্ভরিতা ছাড়া।
সত্যিকার অর্থে ইমাম আশ-শাফি’ঈর “আর-রিসালাহ” গ্রন্থটি বিভিন্ন ফিক্হি স্কুলের জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং এর নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। মিটিয়ে দিয়েছে এই ফিক্হি মাদ্রাসাগুলোর মাঝে চলতে থাকা বাক-বিতন্ডা, রেষারেষি ও বিবাদ। আসলে তো ফিক্হি চিন্তার এই বিভিন্নতা শরি’আর জন্য উত্তম এবং এগুলো শরি’আকে আরও ঐশ্বর্যমন্ডিত করে। এভাবেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ফিক্হ চিন্তা – হিজাযে, শামে, ইরাকে, মিসরে ও তদ্সংশ্লিষ্ট জায়গায় এবং আরও পশ্চিমে যে দেশগুলো রয়েছে সেখানে। এই ভিন্নতা সভ্যতার তৈরির এবং জীবনের পট পরিবর্তনের চাহিদা থেকে উৎসারিত। কেননা বিত্ত ও দারিদ্র্য, শক্তিমত্তা এবং দৌর্বল্য, জ্ঞানের মাত্রা, মানুষের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক – এসবই একজন ফাকীহের চিন্তা ও মত তৈরিতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলে। ‘উমার ইবন ‘আব্দুল -আযীয একারণেই বলতেন: “মানুষ সেই বিচারই পায় যা (সমাজে) প্রচলিত অবক্ষয়ের প্রতিফলক।”[১৬]
তার ফিক্হের উসূল বা নীতিমালা
আবূ হানীফা (র:) বলেন: “আল্লাহ্র রাসূল (সা:) যা বলেছেন তা মাথা পেতে নেয়া হবে, আর সাহাবীরা যা বলেছেন তা থেকে বাছাই করা হবে। এরা ব্যতীত যারা আছেন তারাও মানুষ আর আমরাও মানুষ।”[১৭]
হাসান বিন যিয়াদ আল-লু-লুই (র:) বলেন: “আমি আবূ হানীফাকে বলতে শুনেছি: ‘আমাদের এই কথা হচ্ছে একটি মত মাত্র, আর আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভালো যা বলা সম্ভব আমরা বলেছি, কেউ যদি এসে এর চেয়ে ভালো কথা বলতে পারে তবে অবশ্যই সে-ই গৃহীত হওয়ার বেশি উপযুক্ত।”[১৮]
ইয়াহইয়া বিন দুরায়স (র:) বলেন: “আমি সুফ্য়ানের সাথে ছিলাম, তখন একটি লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনি কী আবূ হানীফাকে কিছু বলবেন না?’ সুফ্য়ান বললেন: ‘কেন তিনি কী করলেন?’ সে বলল: ‘আমি তাকে বলতে শুনলাম: ‘আমি আল্লাহ্র কিতাব থেকে নেব, যদি আল্লাহ্র কিতাবে কিছু না পাই তবে তার রাসূলের সুন্নাহ থেকে। আর যদি আল্লাহ্র কিতাব ও আল্লাহ্র রাসূলের সুন্নাতে কিছু না পাই তাহলে তার সাহাবীদের কথা থেকে। আমি তাদের কথা থেকে যারটা ইচ্ছে নেব আর যারটা ইচ্ছে বাদ দেব, কিন্তু তাদের কথার ওপর আমি অন্যদের কথা স্থান দেব না। হয় এতে ব্যাপারটি শেষ হবে নতুবা চলে আসবে ইবরাহীম, আশ-শা’বী, ইবন সীরীন, হাসান, ‘আতা, সা’ঈদ বিন আল-মুসায়্যাব এবং অন্যান্যদের মতে। তা এনারা ইজতিহাদ করেছেন। তারা যেভাবে ইজতিহাদ করেছেন, আমিও ইজতিহাদ করি।”[১৯]
এই হচ্ছে আবূ হানীফার ফিক্হের উৎসসমূহ। স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি তা ব্যক্ত করেছেন। তিনি ফিক্হের প্রধাণ যে দুটি উৎস তার স্পষ্ট অনুসারী – আল্লাহ্র কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাহ। এরপর তিনি তৃতীয় যে উৎসটি অনুসরণ করেন সেটি হোলো সাহাবীদের মত। যেহেতু তাদের কথা কিছু কিছু ব্যাপারে পুরোপুরি সহমত হয়নি, তাই আবূ হানীফা তার কাছ থেকে নিতেন যাকে তিনি অপরের চেয়ে জ্ঞানের দিক থেকে অগ্রগামী মনে করতেন। এর মাধ্যমে তিনি সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহ্র রাসূলের (সা:) বক্তব্যের অনুসারী করলেন নিজেকে: “আমার সাহাবীরা তারকারাজির মতো, তাদের যে কাউকে তোমরা অনুসরণ করবে, সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।”[২০]
আর তাবি’ঈদের কথা যদি আসে, তাদের সকল মাহাত্ম্যকে মাথায় রেখেই বলা যায় যে তারা জ্ঞানে ও মর্যাদায় সাহাবীদের সমকক্ষ ছিলেন না। আবূ হানীফা নিজেকে ইজতিহাদের যোগ্য মনে করতেন যেভাবে তারা ইজতিহাদ করেছেন। ফলে তাদের ইজতিহাদ তিনি সন্তুষ্ট না হয়ে এবং বাছাই না করে মেনে নিতে রাজি নন। এটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বেশ কজন জাঁহাবাজ তাবি’ঈদের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের কয়েকজনকে তার নিজের শায়খ ধরা হয়। যেমন ‘আতা বিন রাবাহ ও ইবরাহীম আন-নাখা’ঈ – যারা ছিলেন আবূ হানীফার শায়খ হাম্মাদ বিন আবূ সুলায়মানের উস্তাদ।
যেভাবেই ব্যাপারটাকে দেখা হোক না কেন, সন্দেহ নেই আবূ হানীফা ঠিক তেমনি ইজতিহাদ করার জন্য উপযুক্ত ছিলেন যেভাবে তিনি যেসব ‘উলামাদের নাম উল্লেখ করেছেন তারা করতেন। অবশ্যই সাহাবীদের কথা আলাদা।[২১]
হাসান বিন সালেহ (র:) বলেন: “নু’মান বিন সাবিত (আবূ হানীফা) ছিলেন একজন বড় বোদ্ধা, ‘আলেম, যার জ্ঞানের ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। যদি আল্লাহ্র রাসূলের (সা:) কাছ থেকে কোনও খবর তার কাছে সহীহ হিসেবে বর্ণিত হতো তবে তিনি আর অন্য কারও কাছে যেতেন না।”[২২]
তার মতো ইমামদের ব্যাপারে তিনি এরকম ধারণাই রাখতেন। ইমামরা কেউই আল্লাহ্র কিতাবের ব্যাপারে দ্বিমত করতেন না। তবে তারা ইজতিহাদ করতেন যেভাবে আল্লাহ্ তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আর ইজতিহাদের স্বরূপটাই এমন যে এতে বহু মতের ভিড় হবেই। ‘উমার ইবন ‘আবদুল ‘আযীয তাই বলেন: “আমি এটা পছন্দ করি না যে আল্লাহ্র রাসূলের সাহাবীদের মাঝে কোনও মতদ্বৈততা ‘না’ হোক। কারণ যদি মত কেবল একটা হতো তবে মানুষের পথ সংকীর্ণ হয়ে যেত। তারা প্রত্যেকেই অনুসৃত ইমাম। যদি কোনও ব্যক্তি তাদের কোনও একজনের মত অনুসরণ করার সুযোগ পায় তবে সে প্রশস্ততা পেল।”[২৩]
তার মেধা ও যুক্তিবোধ
ইমাম আশ-শাফি’ঈ (র:) বলেন: “ইমাম মালিক বিন আনাসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো: আপনি কী আবূ হানীফাকে দেখেছেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ আমি এমন এক মানুষকে দেখেছি যে যদি তোমাকে বলত যে এই পোলটাকে সে সোনায় পরিণত করে দেবে, তাহলে সে সেটা প্রমাণ করে ছাড়ত।”[২৪]
আন-নাদ্র বিন শুমায়ল বলেন: ” “মানুষ ফিক্হ শাস্ত্রে ঘুমিয়ে ছিলো। আবূ হানীফা ফিক্হকে ভেঙ্গে, ব্যাখ্যা করে ও সংক্ষিপ্ত করে তাকে জাগালেন।”[২৫]
জা’ফর বিন আর-রাবী’ বলেন: “আমি আবূ হানীফার সাথে ৫ বছর ছিলাম, তার চেয়ে অল্প কথার মানুষ আমি আর দেখিনি। আর যখন তাকে ফিক্হের কোনও ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হতো তখন তিনি কথা শুরু করতেন এবং তার কথা ঝর্নার মতো বইতো। তখন তুমি শুনতে পেতে তার গমগমে কন্ঠস্বর ও স্পষ্টভাষিতা।”[২৬]
আল-মুত্তাকী আল-মাক্কী “মানাকীব আবী হানীফা” গ্রন্থে একটি বিতর্ক উল্লেখ করেছেন যা ইমাম আবূ হানীফা ও নাস্তিকদের একটি দলের মাঝে সংঘটিত হয়েছিলো: আবূ হানীফা তাদের বললেন: “তোমারা সেই লোকের ব্যাপারে কী বলবে যে বলছে: আমি একটি মালবোঝাই জাহাজ দেখলাম যা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে পূর্ণ। ঢেউয়ের পর ঢেউ ও বাতাসের গতি তাকে আছড়ে সাগরের মাঝে এনে ফেলেছে। কিন্তু জাহাজটি এর মাঝেও সোজা পথ চলছে যদিও এতে কোনও নাবিক নেই যা একে পরিচালিত করবে বা নেই কোনও নিয়ন্ত্রণকারী যা একে নিয়ন্ত্রণ করবে। বুদ্ধিতে কি এটি সায় দেয়?”
তারা বলল: “না বুদ্ধি তো এটা সায় দেয়ই না, কল্পনাতেও এটা আসে না।”তখন আবূ হানীফা তাদের বললেন: “সুবহানা-ল্লাহ! যদি বুদ্ধিতে এটুকুই না ধরে যে একজন নাবিক ছাড়া একটি জাহাজ পথ চলতে পারবে, তাহলে এই দুনিয়া এর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা, পরিবর্তনশীল ব্যাপারসমূহ, বিস্তৃত দিগন্ত ও কিনারা নিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হোলো একজন স্রষ্টা, সংরক্ষণকারী ও উদ্ভাবক ছাড়াই?”[২৭]
তার তুখোড় বুদ্ধিমত্তা
মুহাম্মাদ বিন ‘আবদুল্লাহ আল-আনসারী বলেন: “আবূ হানীফার যুক্তিতে, হাঁটাচলায়, ভেতরে আসা – বাইরে যাওয়া এসব কিছুতে তার বুদ্ধি টের পাওয়া যেত।”[২৮]
ইয়াযীদ বিন হারূন বলেন: “আমি বহু মানুষ দেখেছি। কিন্তু আবূ হানীফার মতো বুদ্ধিমান, উত্তম ও ধার্মিক কাউকে আর দেখিনি।”[২৯]
ফুটনোট
[১]তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪৬), তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৩), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০৩)।
[২] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০৩), কবিতার পঙক্তি আল-মুতানাব্বির দিওয়ান থেকে (৩/৯২), [অনু: কবিতার পঙক্তি আমি গদ্যে অনুবাদ করেছি।]
[৩] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩০), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০১), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০৩)
[৪] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪৩)
[৫] ঐ
[৬] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪০)
[৭] আল-ইনতিকা: ইবন ‘আবদুল বার্র (পৃঃ ১২৬)
[৮] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪৫)
[৯] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪২৯)
[১০] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩১)
[১১] ঐ
[১২] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৩), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০২), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২)
[১৩] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৩৯)
[১৪] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০১)
[১৫] তারতীবুল-মাদারিক (১/৩৮৬-৩৮৭), আল-ই’তিসাম – আশ-শাতিবী (১/২২৬)
[১৬] আল-ই’তিসাম – আশ-শাতিবী (১/৪৭৬)
[১৭] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০১)
[১৮] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৫২)
[১৯] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৪৩), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২)
[২০] হাদীসটি দা’ঈফ বা দূর্বল। দেখুন: সিলসিলাতুল-আহাদীস আদ-দা’ঈফাহ ওয়াল-মাওদূ’আহ: আল-আলবানী (১/৭৮, নং-৫৮)
[২১] আল-আইম্মাতুল-আরবা’আ: আশ-শুক’আহ (পৃঃ ১৬৪/১৬৫)
[২২] আল-ইনতিকা: ইবন ‘আবদুল বার্র (পৃঃ ১২৮)
[২৩] জামি’ বায়ানিল-‘ইলম ওয়া-ফাদ্লিহি: ইব্ন ‘আবদুল বার্র (২/৮০)
[২৪] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৩৭-৩৩৮), তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪২৯), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৩৯৯)
[২৫] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪৫)
[২৬] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪৭)
[২৭] মানাকিব আবী হানীফা (পৃঃ ৫১)
[২৮] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৯)
[২৯] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩৮)
ছাত্র ও সঙ্গীদের ব্যাপারে তার যত্ন–আত্তি
আবূ হানীফা অনেক সময়ে নিজে কাজ করে ছাত্রদের কাজমুক্ত রাখতেন পড়াশোনায় সময় দেবার জন্য। তিনি তাদের অন্য কোনও কাজ বা পেশায় নিয়োজিত হতে দিতেন না। এজন্য তিনি ছাত্রদের জন্য একটি মাসিক ভাতা ধার্য করতেন। এদের সর্বাগ্রে আছেন আবূ ইউসুফ যিনি দরিদ্র ঘরে জন্মেছিলেন। তার বাবা-মা চেয়েছিলেন তিনি জ্ঞানার্জন থেকে সরে আসুন। তখন আবূ হানীফা ছাত্রের নিজের ও তার পিতামাতার প্রয়োজন মিটানোর ব্যবস্থা করলেন। আবূ ইউসুফ নিজেই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন: “তিনি ২০ বছর আমার ও আমার ওপর নির্ভরশীলদের দেখভাল করেছেন। যখন আমি তাকে বলতাম: ‘আমি আপনার মতো সহৃদয় কাউকে দেখিনি!’ তিনি বললেন: ‘কী বলো! হাম্মাদকে যদি দেখতে তুমি!’ এ থেকে বোঝা যায় যে এরকম মহানুভবতা আবূ হানীফার স্বভাবজাত, আরোপিত নয়। এটা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কসরৎ করে অর্জন করা নয়।[১]
অর্থাৎ আবূ হানীফা তার ছাত্রদের উপকারে আসার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যদি ছাত্র দরিদ্র ঘরের হয়ে থাকে তিনি তার প্রয়োজন মেটাতেন। ছাত্রের নিজের ও তার নির্ভরশীলদের মুক্তহস্তে দিতেন যতক্ষণ না পড়াশোনা শেষ না হয়। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে তিনি তাকে বলতেন: “তুমি সবচেয়ে বড় ধনদৌলতের সন্ধান পেয়ে গেছ হালাল-হারামের জ্ঞান পেয়ে।”[২]
সঙ্গী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদারমনা। তার সাথীরা তার ওপর যথেষ্ট নির্ভর করতেন এবং তার দান-দক্ষিণা থেকে গ্রহণ করতেন এবং তার আচরণের ভূঁয়সী প্রশংসা করতেন। যার কাছে জ্ঞান পেতেন তার জন্য তিনি ছিলেন অনুগত। যাকে শেখাতেন তার জন্য ছিলেন উদার। তিনি বলতেন: “আমি যার কাছে জ্ঞান শিখেছি ও যাকে শিখিয়েছি উভয়ের জন্যই আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।”[৩]
তার ব্যাপারে ‘উলামাদের প্রশংসা
ইমাম আবূ হানীফা (র:) তার জ্ঞান ও সময় খরচ করে মানুষের জন্য বিরাট কীর্তি রেখে গেছেন। ‘উলামারা তার ফিক্হের জ্ঞান ও ইমামত্বের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন এক বাক্যে।
‘আবদুল্লাহ ইবনুল-মুবারাক (র:) বলেন: “যদি আল্লাহ্ আবূ হানীফা ও সুফ্য়ানের মাধ্যমে সাহায্য না করতেন তবে আমি আর সকল মানুষের অবস্থায়ই থেকে যেতাম।”[৪]
সুফ্য়ান ইবন ‘উয়ায়নাহ (র:) বলেন: “আবূ হানীফার মতো কেউ আর আমার চোখে পড়েনি।”[৫]
আবূ দা’ঊদ আস-সিজিস্তানী (র:) বলেন: “আল্লাহ্ আবূ হানীফাকে রহম করুন, তিনি ছিলেন একজন ইমাম।”[৬]
শু’বাহ বিন আল-হাজ্জাজ (র:) যখন আবূ হানীফার মৃত্যুর কথা শুনলেন বললেন: “তার সাথে কূফার ফিক্হও চলে গেল, আল্লাহ্ আমাদের ওপর ও তার ওপর রহমত বর্ষণ করুন।”[৭]
হাম্মাদ বিন যায়দ (র:) বলেন: “আমি হজ্জের সংকল্প করে আয়্যূবের কাছে আসলাম বিদায় নিতে। তিনি বললেন: আমার কাছে খবর এসেছে কূফার ফাকীহ, একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি – অর্থাৎ আবূ হানীফা – এবছর হজ্জ করবেন। যদি তার সাথে তোমার দেখা হয় তবে তাকে আমার সালাম জানিও।”[৮]
‘আবদুল্লাহ বিন দা’ঊদ আল-খারীবী (র:) বলেন: “ইসলামের মানুষদের উচিৎ সালাতে আল্লাহ্র কাছে আবূ হানীফার জন্য দু’আ করা; কেননা তিনি তাদের জন্য সুন্নাহ ও ফিক্হ সংরক্ষণ করেছেন।”[৯]
‘আলী বিন ‘আসিম (র:) বলেন: “যদি ইমাম আবূ হানীফার জ্ঞান তার সময়কার মানুষদের জ্ঞানের সাথে মেপে দেখা হয়, তার জ্ঞান পাল্লায় ভারি হবে।”[১০]
ইব্ন ‘আবদুল-বার্র (র:) বলেন: “তিনি ছিলেন ফিক্হে একজন ইমাম, রায় ও কিয়াস করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত, জ্ঞান তুলে আনার ব্যাপারে দক্ষ, সুন্দর চিন্তার অধিকারী, মেধাবী, ধার্মিক ও ধীশক্তিসম্পন্ন।[১১]
শায়খুল-ইসলাম ইব্ন তাইমিয়্যাহ (র:) বলেন: “যদিও মানুষ কিছু ব্যাপারে তার সাথে দ্বিমত করেছে এবং সেসব ব্যাপার প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু আবূ হানীফার ফিক্হ, ধীশক্তি ও জ্ঞানের ব্যাপারে কেউই সন্দেহ আরোপ করতে পারবে না।”[১২]
তার সাথে মানুষের মতানৈক্য
অন্যান্য সকল বড় ইমামদের মতো আবূ হানীফাও মন্দ ও কষ্টদায়ক কথা থেকে রেহাই পাননি।
আবূ দা’ঊদ আল-খারীবী বলেন: “মানুষ আবূ হানীফার ব্যাপারে দুটি দলে বিভক্ত: তার ব্যাপারে অজ্ঞ এবং তার ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত।”[১৩]
আহমাদ বিন ‘আবদুল্লাহ, একজন কাদী বলেন: “আমার বাবা বলেন: ‘আমরা ছিলাম ইবন ‘আইশার কাছে। তিনি আবূ হানীফার তরফ থেকে একটি বর্ণনা বললেন। এতে অভ্যাগতদের একজন বলল: ‘তাকে আমাদের দরকার নেই।’ তখন ইবন ‘আইশা তাদের বললেন: “যদি তোমরা একবার তাকে দেখতে তবে ঠিকই তাকে তোমরা চাইতে।” (অনু: এরপর তিনি একটি পদ্য বলেন উপমা হিসেবে, যেটি আমি বাদ দিচ্ছি)।[১৪]
আবূ মু’আউইয়া আদ-দুরায়র বলেন: “আবূ হানীফাকে ভালোবাসাটা সুন্নতের পর্যায়ে পড়বে।”[১৫]
এ ধরণের কথা চালু হওয়া ও প্রচার পাওয়াটা ইসলামিক ইতিহাসে মহামহিম ইমামের মর্যাদা সংরক্ষণের প্রমাণ। এ হচ্ছে সকল ইমামগণ, ফুকাহা, ‘উলামা ও মুহাদ্দিসদের অনুসৃত পথ যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুন্দর কথন, একে অপরের প্রশংসা, দলীয় মনোবৃত্তি ত্যাগ করা ও মতপার্থক্যকে বোঝার চেষ্টা করা। এটি ছাত্রবৃন্দ ও অনুসারীদের জন্য সম্মান দিতে শেখা ও শিষ্ট ব্যবহারের তারবিয়াহ। পরস্পরের নামে কথা না বলা ও একে অপরকে অপদস্থ না করা এবং জিহ্বাকে সংযত রাখার তারবিয়াহ। এটি শুধু ইসলামের জ্ঞানী ব্যক্তিদের আখলাক নয়, এটি হওয়া উচিৎ সমগ্র মুসলিমদের আখলাক।
আর যেসব কথা মানুষ বর্ণনা করে বা ছড়ায় যাতে এসব গুণের উল্টোটা পাওয়া যায়, সেসব কথা পরিত্যাজ্য, এসবের কোনও ভিত্তি নেই। অথবা এ হচ্ছে সেসব কথা যা বক্তার দূর্বল মুহুর্তে বলা যখন তিনি চিন্তাভাবনা করে বা মাথা ঠান্ডা রেখে বলতে পারেননি। এধরণের কথা সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ, এগুলোকে আর ছড়াতে দেয়া উচিৎ না বা এগুলোর ওপর ভর করে মত বা সন্দেহ পোষণ করা উচিৎ না। উচিৎ না এগুলোকে ব্যবহার করে আমাদের পূর্বের যুগের মানুষদের ব্যাপারে আজেবাজে ধারণা রাখা। যেমন্টা কিছু মূর্খ ও হঠকারী ব্যক্তি করে থাকে অন্যের ব্যাপারে কুফ্র, বিদ’আত ও পথভ্রষ্টতার কুৎসা রটিয়ে। আমরা আল্লাহ্র কাছে এথেকে ক্ষমা ও মুক্তি প্রার্থনা করি। “আর যারা তাদের পরে এসেছিলো তারা বলে – হে আমাদের রব্ব আমাদের ক্ষমা করুন এবং ক্ষমা করুন আমাদের ভাইদের যারা ঈমান আনার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগণ্য। এবং আমাদের হৃদয়ে ঈমানদারদের ব্যাপারে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব্ব নিশ্চয়ই আপনি পরম স্নেহময় ও দয়ালু।” [আল-হাশ্র: ১০]
এখানে আমরা কিছু বিষয়ের অবতারণা করব যা ইমাম আবূ হানীফার বিপক্ষে বলা হয়।
প্রথমত: তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সহীহ হাদীসের ওপরে কিয়াসকে স্থান দিতেন:
এ কথাটি যে সর্বৈব মিথ্যে সেটা বুঝাতে প্রচুর বর্ণনা উল্লেখ করা যেতে পারে যাতে স্পষ্ট করে প্রমাণিত হয় যে তিনি হাদীসকে কতটা গুরুত্ব দিতেন এবং কিয়াসের ওপরেই তাকে অগ্রাধিকার দিতেন। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হোলো।
১. হাসান বিন সালেহ (র:) বলেন: “নু’মান বিন সাবিত (আবূ হানীফা) ছিলেন একজন বড় বোদ্ধা, ‘আলেম, যার জ্ঞানের ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। যদি আল্লাহ্র রাসূলের (সা:) কাছ থেকে কোনও খবর তার কাছে সহীহ হিসেবে বর্ণিত হতো তবে তিনি আর অন্য কারও কাছে যেতেন না।”[১৬]
২. আবূ হানীফা (র:) নিজে বলেন: “আল্লাহ্র রাসূল (সা:) যা বলেছেন তা মাথা পেতে নেয়া হবে, আর সাহাবীরা যা বলেছেন তা থেকে বাছাই করা হবে। এরা ব্যতীত যারা আছেন তারাও মানুষ আর আমরাও মানুষ।”[১৭]
৩. ইয়াহইয়া বিন দুরায়স (র:) বলেন: “আমি সুফ্য়ানের সাথে ছিলাম, তখন একটি লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনি কী আবূ হানীফাকে কিছু বলবেন না?’ সুফ্য়ান বললেন: ‘কেন তিনি কী করলেন?’ সে বলল: ‘আমি তাকে বলতে শুনলাম: ‘আমি আল্লাহ্র কিতাব থেকে নেব, যদি আল্লাহ্র কিতাবে কিছু না পাই তবে তার রাসূলের সুন্নাহ থেকে। আর যদি আল্লাহ্র কিতাব ও আল্লাহ্র রাসূলের সুন্নাতে কিছু না পাই তাহলে তার সাহাবীদের কথা থেকে। আমি তাদের কথা থেকে যারটা ইচ্ছে নেব আর যারটা ইচ্ছে বাদ দেব, কিন্তু তাদের কথার ওপর আমি অন্যদের কথা স্থান দেব না। হয় এতে ব্যাপারটি শেষ হবে নতুবা চলে আসবে ইবরাহীম, আশ-শা’বী, ইবন সীরীন, হাসান, ‘আতা, সা’ঈদ বিন আল-মুসায়্যাব এবং অন্যান্যদের মতে। তা এনারা ইজতিহাদ করেছেন। তারা যেভাবে ইজতিহাদ করেছেন, আমিও ইজতিহাদ করি।”[১৮]
৪. আবূ হানীফার (র:) উসূলের যে ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত সেটি হোলো যে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ্র ওপর কোনও কিছুকে স্থান দেন না। এরপর তিনি সাহাবীদের মতকে গ্রাহ্য করেন। তবে যে কয়েকটি হাদীসের সাথে তিনি অমত করেছেন সেটা এই বিশ্বাস থেকে করেছেন যে সেগুলো হয় মানসুখ হয়ে গেছে অথবা রহিত হয়ে গেছে অথবা সেগুলো তার কাছে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়নি, বরং এর বিপরীত মতের হাদীসগুলো তার কাছে সঠিক হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: এই অভিযোগ যে হাদীসে তার দূর্বলতা রয়েছে।
ইমাম আবূ হানীফার হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইমামদের মাঝে ইখতিলাফ রয়েছে। তাদের মাঝে একদল তার হাদীসকে গ্রহণ করেন এবং মনে করেন যে যেসব হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন সেই ব্যাপারে তিনি একজন অথরিটি। এরকম যারা মনে করেন তাদের মাঝে আছেন ইয়াহইয়া বিন মা’ঈন, ‘আলী বিন আল-মাদীনী এবং শু’বাহ বিন আল-হাজ্জাজ।[১৯]
আবার আরেকটি দল আছেন যারা তাকে এই ব্যাপারে দূর্বল মনে করেন এবং তার হাদীসকে গ্রহণ করেন না, এই বিষয়ে তার প্রচুর ভুল ও স্মরণশক্তির দূর্বলতার কারণে।[২০]
আয-যাহাবী (র:) বলেন: “ইমাম আবূ হানীফা তার মূল লক্ষ্য ও মনোযোগ বর্ণনা ও বর্ণনাসূত্র (ইসনাদ) সংরক্ষণে নিয়োজিত করেননি, বরং তার মূল সংকল্প ছিলো কুরআন ও ফিক্হের প্রতি। এটা তো যে কোনও ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য যে কিনা একটি শাস্ত্রে মনোনিবেশ করেছে, ফলে তার অন্য কোনোটিতে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। এ কারণেই মুহাদ্দীসগণ বহু কুরআন পাঠকারীদের হাদীসকে দূর্বল সাব্যস্ত করেছেন যেমন, হাফ্স এবং কালূন – বহু দুনিয়াবিমুখ ‘ইবাদাতকারীদের হাদীসে দূর্বলতা পেয়েছেন যেমন, ফারকাদ, আস-সুবখী এবং শাকীক আল-বালখী – বহু (আরবি) ব্যকরণবিদের হাদীসকে দূর্বল হিসেবে ধরেছেন। এটি এ কারণে নয় যে মানুষটির (আবূ হানীফা) ধার্মিকতায় কোনও ত্রুটি ছিলো, বরং হাদীস শাস্ত্রে তার দখল সর্বোচ্চ না হওয়ার কারণে। তা নাহলে তিনি মিথ্যে বলবেন তার তো প্রশ্নই আসে না।”[২১]
তৃতীয়ত: তার বিরুদ্ধে ‘ইরজা‘ (الإرجاء) করার অভিযোগ
যদিও ইমাম আবূ হানীফার প্রশস্ত জ্ঞান, ফিক্হ, ধার্মিকতা, শাসকদের দূরে থাকা ইত্যাদির প্রশংসা অন্যান্য ইমামরা করেছেন, তবে ঈমানের ব্যাপারে তার একটি কথায় তারা ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন, যেটা তারা জরুরি মনে করে উল্লেখও করেছেন। সেটি হোলো ইমাম আবূ হানীফার এই কথা: কর্ম বা ‘আমল ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। এখান থেকেই তার বিরুদ্ধে ইরজা-র অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু এটি আসলে সীমিত ইরজা (إرجاء مقيد)। এটি সেই সাধারণ ইরজা নয় যাতে ইরজা পোষণকারী ব্যক্তি দাবী করে যে ঈমান থাকলে গুনাহ বা পাপাচারে কোনও সমস্যা নেই, ঠিক যেমন ঈমান না থাকলে আল্লাহ্কে মেনে চললেও কোনও লাভ হবে না। এই সাধারণ ইরজা-র মত পোষণকারীদের সাথে ইমাম আবূ হানীফার মতের মিল শুধু এই জায়গাতে যে তিনিও মনে করতেন যে কর্ম বা ‘আমল ঈমানের সংজ্ঞার মাঝে পড়ে না। কিন্তু তাদের সাথে ইমাম আবূ হানীফার মতের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তারা মনে করে ঈমান যদি থেকে থাকে তাহলে পাপকাজ, গুনাহ বা আল্লাহ্র অবাধ্যতা করলেও তাতে কোনও পারলৌকিক সমস্যা হয়না। আর আবূ হানীফার মত ছিলো গুনাহগার ব্যক্তি পারলৌকিক সাজা পাওয়ার উপযুক্ত, যদিও বিচার আল্লাহ্র হাতে। তিনি যদি চান তাকে শাস্তি দেবেন, নচেৎ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এর মানে হোলো এই যে আমাদের একবারেই উচিৎ হবে না ইমামকে সাধারণ অর্থে ইরজা বলতে যা বোঝায় তার ঢালাও অপবাদ দেয়া।
ইমাম আবূ হানীফা (র:) একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি এই মত পোষণ করতেন। বরং হাদীসের জ্ঞানচর্চা ও বর্ণনায় মনোনিবেশ করা বহু জ্ঞানী ব্যক্তিদের এরকম মত ছিলো। এদের মাঝে এমন ব্যক্তিরাও আছেন যাদের হাদীস খোদ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাদের দুই সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
হাফিয ইবন ‘আবদুল বার্র (র:) বলেন: “তারা আবূ হানীফার বিরুদ্ধে ইরজা-র অভিযোগও এনেছে। ‘ইলমের মানুষদের মাঝে ইরজা-র অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন যারা তাদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের ব্যাপারে একজনও বাজে কথা ছড়াতে এতটা পরিশ্রম করেনি যতটা তারা করেছে আবূ হানীফার ব্যাপারে, তার ইমাম হওয়ার কারণে। তার ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেক কিছুই তার নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে যা তার মধ্যে আদতে নেই, এবং এমন সব তার নামে রটানো হয়েছে যার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই।”[২২]
কথাবার্তায় তার সাবধানতা অবলম্বন]
ইবনুল-মুবারাক (র:) বলেন: “আমি সুফ্য়ান আস-সাওরীকে বললাম: ‘আবূ হানীফা গীবত থেকে কী সুন্দর বাঁচিয়ে চলেন! একবারের জন্যও দেখিনি যে তিনি তার প্রতি শত্রুতা পোষণকারী কারও নামে গীবত করছেন।’ সুফ্য়ান বললেন: “আল্লাহ্র শপথ তিনি নিঃসন্দেহে তাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখেন যারা তার ভালো কাজগুলো দখল করে নিতে চায়।”[২৩]
আবূ হানীফার নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে যে যখন তিনি জানতে পারতেন যে কেউ তার নামে খারাপ কিছু বলেছে তিনি বন্ধুসুলভ ভাবে তার কাছে এই মেসেজ পাঠাতেন: “হে ভাই আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন! আমি এই ব্যাপারে তোমাকে তার কাছে ছেড়ে দিলাম যিনি ভালো করেই জানেন যে তুমি আমার নামে যা বলেছ তা ঠিক নয়।”[২৪]
এই ইমামটিও চার বড় ইমামদের অন্যান্যদের মতো পরীক্ষিত হয়েছেন সেসব কথা দিয়ে যা তাদের বিরুদ্ধে চাউড় করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা হয়েছে। মানুষ তাদের ব্যাপারে বিভিন্ন আজেবাজে কথা বলেছে। তাদের বিরুদ্ধে রটানো মন্দ কথাগুলো বিশ্বাস করে নিয়েছে তাড়াহুড়ো করে। ইমাম আবূ হানীফা এসব ক্ষেত্রে তাদের সাথে বিতর্ক বা বাক-বিতন্ডায় জড়াতেন না। ঝগড়া করতেন না। তিনি বরং এড়িয়ে চলতেন। নিজের জন্য ও তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইতেন এবং এরপর তাদের ব্যাপার আল্লাহ্র ওপর ছেড়ে দিতেন। সময়কে কাজে লাগাতেন বরং। সেসব ব্যাপারে জিহ্বাকে ব্যবহার করতেন যাতে রয়েছে উপকার এবং ভালো। জ্ঞান অর্জন ও ফিক্হ চর্চা। অথবা ইবাদাত ও আল্লাহ্র যিক্র। অথবা পার্থিব সৎকর্ম যা চিত্তকে মুক্ত রাখে আজে বাজে চিন্তা থেকে।
এটিই হচ্ছে সেই আদর্শ পথ যা প্রতিটি উত্তম দ্বীনি ও দা’ওয়াতি মানুষের যুগে যুগে অনুসরণ করা উচিৎ। সেসব অকাজের লোকদের সাথে তাদের বিভেদে জড়ানো ঠিক নয় যাদের কথা ছড়ানো ছাড়া আর কোনও কাজ নেই – যারা নিম্নতর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এবং উন্নত চিন্তা ও উত্তম জীবনকে লালন করা থেকে যাদের সংকল্প সরে গেছে।
তার মৃত্যু
এ ব্যাপারে জীবনীকার ও ঐতিহাসিকদের মাঝে ঐকমত্য রয়েছে যে ইমাম আবূ হানীফা (র:) ১৫০ হি: সনে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[২৫] তবে কোন মাসে তিনি ইন্তেকাল করেছেন সে ব্যাপারে দ্বিমত আছে।
আল-হাসান বিন ইউসুফ বলেন: “যেদিন আবূ হানীফা মারা যান সেদিন অত্যধিক ভিড়ের জন্য ছয় বার তার জানাযা পড়া হয়।”[২৬]
আল্লাহ্ আবূ হানীফাকে ক্ষমা করুন। তিনি এক বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার রেখে গেছেন। রেখে গেছেন একদল মেধাবী ছাত্র যাদের তিনি বড় করেছেন ফিক্হের মজলিসে এমন ভাবে যেন তারা চিন্তা করতে শেখে, মত নির্ধারণ করতে পারে, খুঁটিয়ে দেখতে পারে, পরামর্শ করতে পারে এবং বিতর্ক করতে পারে যতক্ষণ না তাদের মন নতুন করে সব কিছু বুঝতে শেখে, যাতে তাদের মেধা সর্বোচ্চ ব্যবহৃত হতে পারে এবং তাদের ইজতিহাদ করার ক্ষমতা পরিপূর্ণ হয়। তিনি এক প্রকান্ড ফিকহি চিন্তাধারা বা মাদ্রাসা রেখে গিয়েছেন যার ফিক্হ, উসূল, ব্যাখ্যা ও তাবৎ বিতর্ককে বিষয়বস্তু করে লিখিত হয়েছে বইয়ের পর বই। তিনি এমন এক মৌলিক ফিক্হি মাযহাব রেখে গেছেন যার ব্যপ্তি শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে আজ এর অনুসারীদের সংখ্যা পৌঁছেছে বহু বহু মিলিয়ন – এই অনুসারীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন মরক্কো, তুরস্ক, ইরাক, মিসর এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। আজও কোনও নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বা কোনও জিজ্ঞাস্য দেখা দিলে ফিক্হ শাস্ত্রবিদগণের জন্য এই মাযহাব একটি ঐশ্বর্যশালী আশ্রয়স্থল। অন্যান্য মাযহাবের ইমামগণ – যারা তার ভ্রাতৃতূল্য – তাদের সাথে তিনিও মুসলিম জাতির যে ক্যারাভান তার একজন অবিসম্বাদিত নেতা। আল্লাহ্ তাদের সকলের ওপর সন্তুষ্টি পোষণ করুন!
ফুটনোট
[১] আল-আইম্মাতুল-আরবা’আ (পৃ: ১০৪)
[২] আখবার আবী হানীফা ওয়া-আসহাবিহি (পৃ: ৪৮)
[৩] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৩৪)
[৪] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪২৮), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৩৯৮)
[৫] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৩৬)
[৬] আল-ইনতিকা: ইব্ন ‘আবদুল বার্র (পৃঃ ৩২)
[৭] আল-ইনতিকা: ইব্ন ‘আবদুল বার্র (পৃঃ ১২৬)
[৮] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৪১)
[৯] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৩২)
[১০] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০৩)
[১১] আল-ইসতিগনা ফী মা’রিফাতিল-মাশহূরীন (১/৫৭২)
[১২] মিনহাজুস-সুন্নাহ (২/৬১৯)
[১৩] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৪১), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২), সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০২)
[১৪] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৪২), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২)
[১৫] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০১)
[১৬] আল-ইনতিকা ইব্ন ‘আবদুল-বার্র (পৃঃ ১২৮)
[১৭] সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা (৬/৪০১)
[১৮] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৪৩), তাহযীবুত-তাহযীব (১০/৪০২), তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৬৯)
[১৯] জামি’ বায়ানিল-‘ইলম ওয়া-ফাদলিহি (২/১৪৯), আল-ইনতিকা: ইব্ন ‘আবদুল-বার্র (পৃঃ ১২৭)
[২০] আত-তারীখুল-কাবীর (৮/৮১), আত-তাবাকাতুল-কুবরা (৬/৩৬৯), আল-মাজরূহীন (৩/৬৩), আল-কামিল ফীদ-দু’আফাহ (৭/২৪৭২-২৪৭৯)
[২১] মানাকিব আবী হানীফা ওয়া-সাহিবায়হ: আয-যাহাবী (পৃঃ ২৮)
[২২] জামি’ বায়ানিল-‘ইলম ওয়া-ফাদলিহি (২/১৪৮)
[২৩] তারীখ বাগদাদ (১৩/৩৬৩)
[২৪] আখবার আবী হানীফা ওয়া-আসহাবিহি – আস-সীমারী (পৃঃ ৩৭)
[২৫] আল-জাওয়াহিরুল-মুদিয়্যাহ (১/৫৪)
[২৬] তাহযীবুল-কামাল (২৯/৪৪৪)